তায়েফে নবীজির (ﷺ) দাওয়াত ও রক্তাক্ত প্রত্যাবর্তন
লেখক: এডমিন
ইতিহাসের এক মর্মস্পর্শী অধ্যায়, যখন রহমতের নবী (ﷺ) তায়েফে পথে পা বাড়ালেন। উদ্দেশ্য একটাই—মানুষকে তাওহিদের আহ্বান জানানো এবং আল্লাহর একত্বের বার্তা পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু যে শহরে তিনি আশা নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানকার মানুষই তাঁকে রক্তাক্ত শরীরে ফিরতে বাধ্য করল। তবুও তাঁর মুখ থেকে কোনো অভিশাপ বের হয়নি, বরং ঝরেছে হিদায়েতের অশ্রু।
তায়েফের পথে প্রিয় নবীজি রাসূলে(ﷺ)দাওয়াত
মক্কার কাফিররা একের পর এক অত্যাচার চালাচ্ছিলেন, তখন নবীজি(ﷺ) নতুন সম্ভাবনার খোঁজে তায়েফের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। তায়েফ ছিল সম্ভাবনাময় একটি শহর। তিনি সাকিফ গোত্রের নেতাদের কাছে ইসলামি দাওয়াত পৌঁছে দেন।
ইবনু ইসহাক ও ইবনু হিশামের বর্ণনা অনুসারে, নবীজি (ﷺ) আব্দে ইয়ালাইল, মাসউদ ও হাবিব নামে তিন নেতার কাছে আহ্বান পেশ করেন। কিন্তু তারা শুধুমাত্র প্রত্যাখ্যানই করেননি, নবীজি (ﷺ)-কে অপমানও করেন।
“আল্লাহ কি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে পেলেন না?”
“যদি তুমি সত্যিই নবী হও, তবে আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই না। আর যদি মিথ্যাবাদী হও, তবে আমার সঙ্গে কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই।”
(সিরাতু ইবনি হিশাম ২/২৮)
পাথর ও রক্তের সাক্ষী
শহরের বখাটে ছেলে-মেয়ে ও দাস-দাসীরা প্রিয় নবীজি রাসূলে পাক (ﷺ)-কে ঘিরে ধরে। দুই সারি করে দাঁড়িয়ে তাঁকে পাথর ছুঁড়তে থাকে। সিরাতু ইবনি হিশাম ও সহিহ বুখারিতে এসেছে, এত বেশি আঘাতের ফলে নবীজি (ﷺ)-এর পা থেকে রক্ত প্রবাহিত হয়। সঙ্গে থাকা হজরত জায়েদ ইবনু হারিসা (রা.)-ও আহত হন।
নবীজি (ﷺ) ক্লান্ত শরীরে একটি বাগানে আশ্রয় নেন, যা উতবা ও শাইবা ইবনু রাবিয়ার মালিকানাধীন ছিল। সেখানে তিনি আল্লাহর কাছে দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে দুআ করেন।
প্রিয় নবীজি রাসূলে (ﷺ)দুআ
নবীজি (ﷺ)-এর দুআতে প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর বিনয়, ধৈর্য ও আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা:
اللَّهُمَّ إِلَيْكَ أَشْكُو ضَعْفَ قُوَّتِي، وَقِلَّةَ حِيلَتِي، وَهَوَانِي عَلَى النَّاسِ
হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে অভিযোগ করছি আমার দুর্বলতার, অসহায়ত্বের এবং মানুষের কাছে আমার হীনতার।
يَا أَرْحَمَ الرَّاحِمِينَ، أَنْتَ رَبُّ الْمُسْتَضْعَفِينَ وَأَنْتَ رَبِّي
হে পরম দয়ালু! তুমি নিপীড়িতদের রব, তুমি-ই আমার রব।
(সিরাতু ইবনি হিশাম ২/২৯
ফেরেশতাদের প্রস্তাব ও নবীজির(ﷺ) ক্ষমাশীলতা
আল্লাহ জিবরাইল আ.কে প্রেরণ করেন। সহিহ বুখারিতে এসেছে,
“হে মুহাম্মাদ, আমি প্রেরিত হয়েছি আপনার আদেশের অপেক্ষায়। আপনি চাইলে আমি তায়িফের দুই পাহাড়ের মধ্যে তাদের চাপা দিয়ে ধ্বংস করে দিতে পারি।”
(সহিহ বুখারি:৩০৫৯)
কিন্তু নবীজি (ﷺ) ক্ষমাশীলতার প্রতীক হয়ে বললেন:
“না, আমি আশা করি আল্লাহ তাদের বংশধরদের মধ্যে থেকে এমন লোক বের করবেন, যারা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে।”
(সহিহ বুখারি:৩০৫৯)
তায়েফ থেকে শিক্ষণীয় দিকঃ
কুরআনে আল্লাহ তাআলা নবীকে সান্ত্বনা দেন:
فَاصْبِرْ صَبْرًا جَمِيلًا
অতএব, তুমি ধৈর্য ধারণ করো সুন্দর ধৈর্য সহকারে। (সুরা মাআরিজ ৭০:৫)
তায়েফের ঘটনা আমাদের শেখায়—দাওয়াতের পথ কখনো সহজ নয়। অন্যের অত্যাচারের প্রতিক্রিয়ায় প্রতিশোধ নয়, বরং হিদায়েতের জন্য দুআ করতে হবে। নবীজি (ﷺ)-এর ধৈর্য, দয়া ও ক্ষমাশীলতা আমাদের জীবনের জন্য চিরন্তন শিক্ষণীয়।
তায়েফের পথে নবীজি (ﷺ)দাওয়াত ছিল এক ভালোবাসার আহ্বান, আর তাঁর রক্তাক্ত শরীর ছিল ধৈর্য ও ত্যাগের সাক্ষ্য। ফেরেশতারা শহর ধ্বংসের প্রস্তাব দিলেও তিনি ক্ষমার দুআ করলেন—এটাই মানবতার প্রতি তাঁর মূল বার্তা।….
চলমান..