ইসলাম শুধু মসজিদ বা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি জীবনের সর্বক্ষেত্রের জন্য পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা দেয়। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনের প্রতিটি দিকেই আছে অনুসরণীয় আদর্শ, যা ঘরের ভিতর থেকে কর্মস্থল পর্যন্ত সর্বত্র আমাদের পথপ্রদর্শক। কুরআনে আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন: “রাসূল তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ”।
প্রবর্তিত জীবনধারা হিসেবে নবীজির সুন্নাহ আঁকড়ে ধরার ব্যাপারে তিনি নিজেই ওসিয়ত করেছেন – “আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যদি তা দৃঢ়ভাবে ধারণ করো তবে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না; তা হলো আল্লাহর কিতাব এবং আমার সুন্নাহ”। তাই আধুনিক যুগের তরুণ পরিবারগুলোর উচিত ঘরে ও বাইরে, জীবনের সব ক্ষেত্রে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সুন্নাহর শিক্ষাগুলো বাস্তবে প্রয়োগ করা। নিচে আধুনিক পারিবারিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে সুন্নাহ চর্চার কিছু বাস্তব কৌশল আলোচনা করা হলো।
পারিবারিক জীবনে সুন্নাহ অনুশীলন
পরিবার হল সেই স্থান, যেখানে আমাদের চরিত্র ও মূল্যবোধের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ পায়। নবী করিম (সা.) বলেছেন: “তোমাদের মধ্যে সে লোকই উত্তম, যে নিজের পরিবার-পরিজনের প্রতি উত্তম আচরণ করে”। আধুনিক ব্যস্ত জীবনে ঘরোয়া শান্তি ও বরকত ধরে রাখতে আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর পারিবারিক সুন্নাহগুলো অনুসরণ করতে পারি। উদাহরণস্বরূপ:
- পরিবারের সাথে সদাচরণ ও দয়া: পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কোমলতা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করা সুন্নত। নবীজী শিশুদের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল ছিলেন; হাদীসে এসেছে, তিনি নিজের নাতিকে চুম্বন করছিলেন, তখন এক মরুঝাঁপ ব্যক্তি বলল, “আমার দশটি সন্তান আছে, আমি কখনো তাদের চুম্বন করিনি।” রাসূল (সা.) জবাবে বললেন: “যে দয়া করে না, সে দয়া পাবে না”। তাই বাড়িতে বাবা-মায়েরা সন্তানের সঙ্গে এবং স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের সাথে দয়া, সহমর্মিতা ও ভালোবাসার সুন্নতী আচরণ করবেন। ছোটখাটো উদাহরণ হিসেবে, কর্মশেষে বাসায় ফিরে হাসিমুখে সালাম দেয়া, সন্তানদের আদর করা কিংবা জীবনসঙ্গীর সাথে সহানুভূতিশীল কথা বলা – এসবই সুন্নাহর পরিপালন এবং এতে পরিবারে ভালোবাসা বাড়ে।
- গৃহকর্মে সাহায্য করা: পরিবারের কাজকর্মে অংশ নেওয়া রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সুন্দর সুন্নাহ। হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন যে, নবীজি ঘরের কাজে পরিবারের লোকদের সহায়তা করতেন; আজান শুনলেই নামাজের জন্য বাইরে চলে যেতেন। অর্থাৎ তিনি ঘরের কাজকে তুচ্ছ করেননি বরং পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করেছেন। আধুনিক যুগে স্ত্রী বা পরিবারের অন্য সদস্যদের ওপর সব কাজ চাপিয়ে না দিয়ে স্বামী বা পুরুষ সদস্যেরাও ঘর পরিষ্কার, বাজার করা, বাচ্চাদের দেখাশোনা ইত্যাদিতে সহযোগিতা করলে পারিবারিক বন্ধন মজবুত হয় এবং সুন্নতেরও অনুকরণ হয়। যেমন, রাতে খাবার পরে বাসনের কিছু অংশ নিজে ধুয়ে রাখা বা সন্তানকে পড়াতে বসা – এসব কাজ নবীজির পরিবার-সহায়ক আচরণেরই প্রতিফলন।
- পরিবারের সাথে একসাথে সময় ও ইবাদত করা: রাসূল (সা.) পরিবারের সাথে সময় কাটাতেন এবং পারিবারিক পরিবেশে আল্লাহর স্মরণ জারি রাখতেন। তিনি পরিবার নিয়ে একত্রে খাবার খেতে বসতেন, খাবারের আগে-ব পরে দোয়া করতেন এবং সবাইকে বিসমিল্লাহ বলতে শেখাতেন। পরিবারের সদস্যদের সাথে একসাথে নামাজ পড়া বা রাতে শিশুদের ছোট ছোট দোয়া ও কুরআনের সূরা শেখানো সুন্নাতের চর্চা হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে, মা-বাবা মাগরিবের পর কিছুক্ষণ পারিবারিক মজলিসে নবীজির কোনো হাদীস শোনালেন বা শিশুদেরকে ছোট কারীমা (দোয়া) শিখালেন – এতে পরিবারে দ্বীনি পরিবেশ গড়ে উঠবে। কুরআনে আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দেন: “হে ঈমানদাররা! তোমরা নিজেদের ও পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো”। তাই পরিবারের সবাইকে নিয়ে ফরজ ইবাদত পালনে যত্নবান হওয়া এবং ইসলামের মৌলিক শিক্ষাগুলো ঘরেই চর্চা করা জরুরি।
- সালাম ও সুন্নতী অভিবাদন: নবীজি ঘরে প্রবেশের সময় হাসিমুখে সালাম দিতেন এবং পরিবারের জন্য দোয়া করতেন। সালামের মাধ্যমে ঘরে শান্তি ও বরকত প্রবেশ করে। আজকাল অনেকে বাইরে সুন্দর আচরণ করলেও ঘরে ফেরার পর ক্লান্তি বা মানসিক চাপে পরিবারের সাথে অভদ্র ব্যবহার করেন। এটি ঠিক নয়। সুন্নাহ হলো – ঘরে প্রবেশেই “আসসালামু আলাইকুম” বলে শান্তির দোয়া দেয়া এবং পরিবারের সবার খোঁজখবর নেয়া। এই ছোট সুন্নতটি সম্পর্কের মধ্যে মহানুভবতা আনে। উদাহরণস্বরূপ, অফিস থেকে ফিরে মোবাইল ফোন একপাশে রেখে আগে স্ত্রী-সন্তানদের সাথে কুশল বিনিময় করুন, তাঁদের দিনকাল জানতে চান – এটা নবীজির পারিবারিক আদর্শেরই অনুসরণ।
সংক্ষেপে, পারিবারিক জীবনে সুন্নাহ চর্চার মূলমন্ত্র হলো পরিবারের প্রতি উত্তম ব্যবহার, দয়া-মমতা, সহযোগিতা এবং আল্লাহর স্মরণ প্রতিষ্ঠা করা। নবীজি বলেন, “তোমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সে, যে তার পরিবারে সর্বশ্রেষ্ঠ” – এই বাণীকে সামনে রেখে আমরা যদি ঘরের পরিবেশ সুন্নাহময় করি, তাহলে ইনশাআল্লাহ আমাদের পরিবার হবে শান্তি, ভালোবাসা ও কল্যাণে পরিপূর্ণ।
কর্মজীবনে সুন্নাহর প্রয়োগ
আমাদের আয়ের স্থান তথা কর্মক্ষেত্রেও ইসলামের নীতি-আদর্শ মেনে চলা জরুরি। প্রফেশনাল জীবনে সততা, অধ্যবসায়, ন্যায়পরায়ণতা ও উত্তম চরিত্র দেখানো একজন মুমিনের পরিচয়। মহানবী (সা.) কর্মজীবনে সততা ও বিশ্বস্ততার অনন্য নজীর স্থাপন করেছেন। তিনি সতর্ক করে বলেছেন: “যে আমাদের সাথে প্রতারণা করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়”। অর্থাৎ ব্যবসা বা চাকরিতে অসাধুতা, প্রতারণা বা দুর্নীতিমূলক আচরণ ঈমানদারের কর্মসংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক। আধুনিক কর্মক্ষেত্রে নিম্নলিখিত সুন্নাহসম্মত কৌশলগুলো অবলম্বন করা যেতে পারে:
- সততা ও আমানতদারিতা বজায় রাখা: অফিস বা ব্যবসার কাজে সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততা সুন্নতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। লেনদেন ও দাফতরিক কাজে জালিয়াতি, মিথ্যা তথ্য প্রদান বা প্রতারণা থেকে বিরত থাকতে হবে। হাদীসে এসেছে, নবীজি বলেছেন – “যে ব্যক্তি ঠকায়, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়”। কাজেই পরীক্ষায় নকল করা থেকে শুরু করে ব্যবসায় ও চাকরিতে প্রতারণামূলক যে কোন কাজ কঠোরভাবে পরিত্যাগ করা উচিত। একজন প্রকৃত মুসলিম কর্মী বা উদ্যোক্তা সে-ই, যার কাছে সহকর্মী ও গ্রাহকরা নিরাপদ থাকে এবং যার ব্যবহারে আস্থা পায়। উদাহরণ হিসেবে, অফিসে যদি কেউ অনুপস্থিত সহকর্মীর ক্রেডিট নিতে চায় বা মিথ্যা অজুহাতে অফিসের সম্পদ অপব্যবহার করতে চায় – আপনি সুন্নাহর শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বরং সততা অবলম্বন করবেন এবং নির্ধারিত নিয়ম মেনে চলবেন।
- পরিশ্রম ও পেশাগত উৎকর্ষতা: ইসলামে কাজকে ইবাদতের অংশ গণ্য করা হয় যখন তা হালাল উপায়ে এবং আন্তরিকতার সাথে করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে কঠোর পরিশ্রম করে জীবিকা অর্জনকারী মানুষকে শ্রদ্ধা করতেন এবং উম্মতকে পরিশ্রমী হতে উৎসাহিত করেছেন। এক হাদীসে আছে: “শক্তিশালী মুমিন দুর্বল মুমিন থেকে উত্তম ও আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়” – এতে নৈতিক ও শারীরিক দৃঢ়তাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, যা পরিশ্রম ও কর্মদক্ষতার সাথেও সম্পর্কিত। তাই কর্মক্ষেত্রে আমাদের উচিত আলসেমি বা অবহেলা না করে কাজটিকে যথাসম্ভব ভালোভাবে সম্পন্ন করা। এ যুগে প্রোফেশনাল দক্ষতা বৃদ্ধি, সময়মত কাজ শেষ করা, নিয়মানুবর্তিতা ইত্যাদি মুসলিমের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত। যেমন, অফিসের প্রকল্পগুলিকে সময়সীমার মধ্যে মানসম্পন্নভাবে শেষ করা বা নিজের কাজের দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ নেয়া – এসবই ইসলামসম্মত ইতিবাচক পদক্ষেপ।
- ন্যায়পরায়ণতা ও অধীনস্থদের প্রতি সুবিচার: যদি আপনি ম্যানেজার, মালিক বা দলের নেতা হন, তবে সুন্নাহ অনুসারে অধীনস্থ কর্মচারী বা সহকর্মীদের প্রতি ন্যায়বান ও সহানুভূতিশীল হোন। নবীজি শ্রমিকের হক আদায়ে জোর দেন এবং বলেছেন: “কর্মচারীর ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি দিয়ে দাও”। এর অর্থ, সময়মত ও পুরোপুরি প্রাপ্য পারিশ্রমিক দেয়া এবং অধীনস্থদের পরিশ্রমের মূল্যায়ন করা ইসলামের দাবি। আজকের যুগে অনেক প্রতিষ্ঠানে বেতন দিতে বিলম্ব বা শ্রমিকের অধিকার হরণ সাধারণ সমস্যা, যা স্পষ্ট অন্যায়। একজন মুসলিম কর্তৃপক্ষ তা এড়িয়ে চলবে। বাস্তব উদাহরণ হিসাবে, আপনি যদি কোম্পানির মালিক হন, তবে প্রতিমাসে নির্ধারিত তারিখে কর্মীদের বেতন পরিশোধ নিশ্চিত করবেন এবং অতিরিক্ত সময় কাজ করলে উপযুক্ত ওভারটাইম দিবেন – এটাই সুন্নতের শিক্ষা। এছাড়া কর্মস্থলে সবাইকে সম্মান করা, গালি-গালাজ থেকে বিরত থাকা এবং যৌথ কাজে একে অপরকে সাহায্য করা সুন্নতী আচরণ। হাদীসে আছে, নবীজি সর্বদা দুর্বল ও শ্রমজীবীদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকতেন এবং তাদের প্রয়োজনে সাহায্য করতেন।
- প্রার্থনা ও ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা রক্ষা: কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ততার অজুহাতে ইসলামের ফরজ বিধানগুলো অবহেলা করা যাবে না। সাহাবীদের জীবন থেকে আমরা দেখি, তারা ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করলেও নামাজের সময় হলে সঙ্গে সঙ্গে সব কাজ থামিয়ে দিতেন। কুরআন বলেছে: “এমন লোকও আছে যাদের ব্যবসা ও কেনাবেচা তাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে এবং নামাজ কায়েম থেকে বিমুখ করে না” (২৪:৩৭)। তাই অফিসে বা দোকানে কাজের ফাঁকে সঠিক সময়ে নামাজ আদায় করা, জুমার দিন ছুটি নিয়ে মসজিদে যাওয়া – এসবের ব্যবস্থা করতে হবে। আপনি যদি নিয়োগকর্তা হন, কর্মীদের নামাজের বিরতি ও জায়নামাজের জায়গা নির্দিষ্ট করে দিতে পারেন। আর কর্মী হলে নামাজকে অগ্রাধিকার দিয়ে সে অনুযায়ী কাজের সময় ভাগ করবেন। এভাবে কাজ ও দ্বীনের সমন্বয় করাই সুন্নতের দাবি। যেমন, দুপুরের খাবারের সময়টা ব্যবহার করে জোহর/আসর পড়ে নেওয়া বা অফিস শেষে মাগরিবের সময় বাসায় পৌঁছে প্রথমেই নামাজটা সেরে নেওয়া – এ ধরনের অভ্যাস আপনাকে দ্বীনের উপর অটল রাখবে এবং কাজে বরকতও বাড়াবে।
সারসংক্ষেপে, কর্মজীবনে সুন্নাহ চর্চা মানে নিজের পেশাকে ইবাদত হিসেবে দেখা এবং সেখানে সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা ও কল্যাণকর আচরণ প্রতিষ্ঠা করা। এতে পরকালীন সফলতার পাশাপাশি পৃথিবীতেও সুনাম ও আস্থা অর্জিত হবে। নবীজির শিক্ষামতো যে কর্মী বা ব্যবসায়ী আমানতদার, সত্যবাদী ও পরোপকারী, তিনি কিয়ামতের দিনে নবীদের সঙ্গ লাভের মর্যাদা পাবেন বলে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ আমাদের কর্মস্থলে সুন্নাহ মোতাবেক চলার তৌফিক দিন।
প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগে সুন্নাহর চর্চা
আধুনিক যুগে ইন্টারনেট, স্মার্টফোন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের জীবনের বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। এগুলোর সঠিক ব্যবহার এবং অপব্যবহার – দুটোই আমাদের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ। যদিও প্রযুক্তি নিজেই নিরপেক্ষ, এর ব্যবহারে ইসলামের নীতিমালা মেনে চলা একান্ত প্রয়োজন। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সময় সরাসরি সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না, তবে তিনি যে নীতিগুলো দিয়ে গেছেন সেগুলো ডিজিটাল জগতে সমান প্রযোজ্য। ইসলাম আমাদের বলে, প্রকাশ্য-গোপন সর্ব অবস্থায় আল্লাহকে ভয় করতে এবং জবাবদিহিতার কথা স্মরণ রাখতে। সামাজিক যোগাযোগ ও অনলাইন কার্যক্রমে নিম্নোক্ত সুন্নাতসম্মত আচরণ অনুসরণ করা যেতে পারে:
- সত্যবাদিতা ও যাচাই-বাছাই: ফেসবুক, টুইটার বা হোয়াটসঅ্যাপে কোনো খবর, গুজব বা তথ্য শেয়ার করার আগে তা সত্য কিনা যাচাই করা ঈমানের অংশ। কুরআনে সাফ নির্দেশ এসেছে: “হে ঈমানদারগণ! যদি কোনো অসৎ ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তা পরীক্ষা করে দেখো, যেন অজ্ঞতাবশতঃ তোমরা কেউকে ক্ষতি করে না বসো”। সুতরাং সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো পোস্ট দেখেই মুগ্ধ হয়ে বা ক্রুদ্ধ হয়ে তা শেয়ার করে দেয়া সুন্নতের পরিপন্থী হতে পারে যদি সেটা মিথ্যা হয়। মুসলিম হিসেবে আমাদের সচেতন ডিজিটাল নাগরিক হতে হবে – কোনো খবরের সত্যতা নিশ্চিত না হয়ে ফরওয়ার্ড না করা, কারো বিরুদ্ধে শুনে নিয়ে সাথে সাথে বদনাম না করা ইত্যাদি পালন করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো ভাইরাল সংবাদ পেলেন যে “অমুক কোম্পানির পণ্য হারাম” – তখন সাথে সাথে শেয়ার না করে প্রথমে বিশ্বস্ত সোর্স থেকে যাচাই করবেন। এভাবে চললে অনলাইনে গুজব ও অপপ্রচার রোধে আপনি সুন্নাহর অনুসারী হবেন।
- গিবত ও অশোভন কথাবার্তা থেকে বিরত থাকা: অনলাইনে আমরা মুখোমুখি না থাকায় অনেকেই লেখনীতে শিষ্টাচার ভুলে যাই। কারো ছবিতে বা স্ট্যাটাসে কটু মন্তব্য করা, ব্যক্তিগত দুর্বলতা নিয়ে সবাইকে জানিয়ে দেয়া (যা মূলত গিবত/পরনিন্দা), কিংবা অশ্লীল শব্দ ব্যবহার – এগুলো অনেকে অনলাইনে খুব সহজে করে ফেলে। কিন্তু স্মরণ রাখা উচিত, ইসলামে পরনিন্দা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ; আল্লাহ বলেন, “এক ভাই অন্য ভাইয়ের পচা মাংস খাওয়ার মতো ঘৃণ্য কাজ” এটি। নবীজি শিখিয়েছেন: “যে আল্লাহ ও পরকালকে মানে, সে ভালো কথা বলবে নতুবা চুপ থাকবে”। সুতরাং ফেসবুকের কমেন্ট হোক বা মেসেঞ্জার গ্রুপ, আমাদের জিহ্বা/কলম (কীবোর্ড) সংযত রাখা সুন্নাহ। কোনো বিষয়ে ভিন্ন মত থাকলে গালি না দিয়ে যুক্তিপূর্ণ ভদ্র ভাষায় বলুন, নইলে চুপ থাকুন। গসিপ বা ট্রলের সংস্কৃতি ইসলামসম্মত নয়। প্রয়োজনে অনলাইনে কারো সমালোচনা করতে হলে সম্ভাব্য সুন্দর ভাষা ও নরমভাবে উপদেশের স্টাইলে বলুন, যেন সেটি উপকারে আসে। মনে রাখবেন, “একজন প্রকৃত মুসলিম সে, যার জিহ্বা ও হাতের অনিষ্টতা থেকে অন্য মুসলিমরা নিরাপদ থাকে” – ভার্চুয়াল জগতেও এ হাদীসের বাস্তবায়ন জরুরি।
- পর্নোগ্রাফি ও অশ্লীল কনটেন্ট থেকে দূরে থাকা: ইন্টারনেটের সবচেয়ে বড় ফিতনা হলো অশ্লীলতা সহজলভ্য হওয়া। কিন্তু ইসলামের শিক্ষা হল, প্রকাশ্যে হোক বা একান্তে – আমাদের চোখ, কান ও অন্তরকে পাপ থেকে হেফাজত করা। কুরআনে এসেছে, মুমিন পুরুষ ও নারীদেরকে দৃষ্টি অবনত রাখতে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করতে বলা হয়েছে (নূর:৩০-৩১)। সুতরাং অনলাইনে চোখের সামনে কোনো অনৈসলামিক বা অশালীন বস্তু এলে সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া বা স্ক্রল পেরিয়ে যাওয়া উচিত। পর্নোগ্রাফি দেখা বা ছুপে ছুপে হারাম যোগাযোগ করা মহান গুনাহ, যা আমাদের আত্মাকে ধ্বংস করে এবং বাস্তব জীবনকেও বিপর্যস্ত করে। নিজেকে এ থেকে বাঁচাতে সবসময় আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকা জরুরি। স্মরণ রাখুন, আমাদের অনলাইন কার্যকলাপও আল্লাহ দেখছেন এবং ফেরেশতারা লিপিবদ্ধ করছেন। তাই কম্পিউটার বা মোবাইলে একা থাকলেও মনে করবেন না যে আপনি একা – আল্লাহর উপস্থিতির সচেতনতা (মুরাকাবা) রাখুন। এভাবে অনলাইন দুনিয়াতেও তাকওয়া বজায় রাখাই নবীজির আদর্শ।
- সময় অপচয় রোধ ও উপকারী প্রযুক্তি ব্যবহার: প্রযুক্তির সুফল পেতে হলে এর অপব্যবহার এড়াতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বা ইউটিউবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অর্থহীন স্ক্রলিং করা, গেমসে ডুবে থাকা ইত্যাদি সময়ের অপচয়; হাদীসে এসেছে: “দুটি নিয়ামতের ব্যাপারে বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত: সুস্থতা এবং অবসর সময়”। সুতরাং আমাদের ফ্রি সময়ের জবাবদিহিতাও আছে। সুন্নাহ মোতাবেক চলতে চাইলে বিনোদন ও প্রযুক্তি ব্যবহারে ভারসাম্য আনতে হবে। দিনে কতক্ষণ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে ব্যয় করছেন তা সীমিত করুন। আপনি স্মার্টফোনে এমন কিছু অ্যাপ বা ফিল্টার রাখতে পারেন যা অপব্যয় রোধ করে। অন্যদিকে প্রযুক্তিকে ভালো কাজে লাগান – ইসলামিক লেকচার শোনা, কুরআন-হাদীসের অ্যাপ ব্যবহার, নিয়মিত উল্লেখযোগ্য খবরগুলো জানা ইত্যাদি উপকারী কাজে ইন্টারনেট ব্যবহার করুন। উদাহরণস্বরূপ, দৈনিক একটি ইসলামী ভিডিও/লেকচার শোনা। নবীজি বলেন, “যে কল্যাণের দিকে পথ দেখায়, সে যেন সেই কল্যাণ কর্মটি নিজে করলো” – সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাল বিষয় শেয়ার করে আপনি পরোপকার করতে পারেন। তবে সবকিছুর মাপকাঠি হল নিয়ত ঠিক রাখা এবং শরীয়তের সীমা অতিক্রম না করা।
- অনলাইন যোগাযোগে সৌজন্যতা ও শালীনতা: ভার্চুয়াল যোগাযোগে আমাদের আচরণ বাস্তব জগতের মতোই ভদ্র ও শালীন হওয়া জরুরি। রাসূল (সা.) সর্বদা মিষ্টি ভাষায় কথা বলতেন, মুখে হাসি রাখতেন এবং সামনাসামনি দেখা হলে সালাম দিয়ে অভিবাদন জানাতেন। অনলাইনেও কারো সঙ্গে চ্যাট শুরু করলে সালাম দিয়ে শুরু করুন, সম্ভাষণের উত্তরে উত্তম জবাব দিন। মেসেজে অথবা ইমেইলে শিষ্টাচার বজায় রেখে কথা লিখুন – ‘ধন্যবাদ’, ‘অনুগ্রহ করে’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করতে পারেন। কারো মতের বিরোধিতা করলে ভদ্রভাবে করুন। একটা সুন্নতী উদাহরণ হলো মুচকি হাসি – যদিও ইমোজি দিয়ে এটি বোঝানো হয়, তবে বাস্তবে সুযোগ হলে ভিডিও কলে বা লাইভে মুখে হাসি রাখুন; হাদীসে আছে: “তোমার ভাইয়ের মুখের উপর হাসিমুখে থাকা তোমার জন্য একটি সাদকা (দান)”। তাই ভার্চুয়াল মিটিং হোক বা টেক্সট, আপনার ভদ্রতা, সদয় ভঙ্গি ও সুন্দর শব্দচয়ন দ্বারাও আপনি ইসলামকে উপস্থাপন করছেন। নবীজি আরো বলেন, “ভালো কথাও দানের সমতুল্য” – অর্থাৎ অনলাইন কমেন্টে বা পোস্টে উৎসাহমূলক সুন্দর বাক্য লিখলে সেটিও নেকির কাজ হতে পারে। অপরদিকে অহেতুক বিতণ্ডা করা, ট্রল করা বা অন্যকে অপমান করা সম্পূর্ণ বর্জনীয়। সামাজিক মাধ্যমে সুন্নাহসম্মত শিষ্টাচার রক্ষা করলে আপনি দ্বীনকে সমুন্নত রাখার পাশাপাশি নিজের অনলাইন মান-мর্যাদাও রক্ষা করতে পারবেন।
সংক্ষেপে, প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগের জগতে আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে নবীজির শিক্ষা প্রয়োগ করতে হবে – সত্য বলুন, অসত্য এড়ান; ভাল কথার প্রসার করুন, মন্দ কথা থেকে বিরত থাকুন; পর্দা রক্ষা করুন এবং বিনয় ও সৌজন্য বজায় রাখুন। এভাবে ডিজিটাল জগতকে সুন্নাহর আলোয় আলোকিত করা সম্ভব।
স্বাস্থ্য ও সুস্থ জীবনে সুন্নাহ
শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা আল্লাহর বড় নিয়ামত, এবং এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের অমূল্য দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। আধুনিক জীবনযাত্রায় অসংযমী খাদ্যাভ্যাস, অলসতা ও স্ট্রেসের কারণে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু নবীজি তার জীবনচর্চায় ভারসাম্য ও পরিমিতিবোধের আদর্শ দেখিয়েছেন, যা অনুসরণ করলে আমরা আরও সুস্থ ও সাবলীল জীবনযাপন করতে পারি। কিছু বাস্তব কৌশল:
- পরিমিত খাদ্যাভ্যাস: ইসলামের শিক্ষা হল, খাবারে অতিভোজন না করে ভারসাম্য রাখা। হাদীসে এসেছে: “আদম সন্তানের পেটের চেয়ে নিকৃষ্ট পাত্র আর কিছু নয়; মানুষ কয়েকটি লোকমা দিয়ে নিজের পিঠ সোজা রাখতে পারলেই যথেষ্ট। অবশ্য সম্পূর্ণ ক্ষুধা মেটাতে চাইলে পেটের এক-তৃতীয়াংশ খাবার, এক-তৃতীয়াংশ পানি এবং এক-তৃতীয়াংশ অংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য খালি রাখা উচিত”। আধুনিক পুষ্টিবিজ্ঞানেও অতিরিক্ত খাওয়ার ক্ষতি প্রমাণিত – ওজন বৃদ্ধি, ডায়াবেটিস, হাইপ্রেশার ইত্যাদি। তাই সুন্নাহ অনুযায়ী আমাদের উচিত ক্ষুধার তীব্রতা থাকতেই খাওয়া বন্ধ করা এবং পেট ভরে না খাওয়া। প্লেট ভর্তি করে না নিয়ে প্রয়োজনমতো নিন, ধীরে ধীরে চিবিয়ে খান, এবং খাবার浪চ ও অপচয় করবেন না; কুরআনের নির্দেশ, “তোমরা খাও ও পান করো, কিন্তু অপচয় করোনা, নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না” (৭:৩১)। ঘরে পরিবারের সবার মাঝে এই শিক্ষা দিন – শিশুদেরও ছোট থেকেই বুঝান যে খাবার অপচয় করা বা অতিভোজন করা ঠিক নয়। সুন্নাহর আরেকটি দিক হল হালাল ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা এবং খাওয়ার শুরুতে “বিসমিল্লাহ” ও শেষে “আলহামদুলিল্লাহ” বলা, যা খাবারে বরকত আনে।
- স্বাস্থ্যকর দৈনন্দিন অভ্যাস: পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা ইসলামের অর্ধেক ঈমানের অংশ। নবীজি দৈনন্দিন জীবনে নিয়মিত মিসওয়াক (প্রাকৃতিক টুথব্রাশ) ব্যবহার করতেন, যা মুখগহ্বরের স্বাস্থ্য রক্ষায় দারুণ উপকারী। তিনি ভোরে উঠার সময় হাত ধুয়ে নিতেন, ঘুম থেকে উঠেই মুখে পানি দিয়ে পরিষ্কার করতেন – আজকের জীবনে এসব অভ্যাস স্বাস্থ্যবিজ্ঞানসম্মত। আমাদেরও উচিত সকাল-বিকাল দাঁত ব্রাশ করা, হাত-মুখ পরিষ্কার রাখা, খাদ্যের আগে-পরে হাত ধোয়া প্রভৃতি সুন্নত মেনে চলা। এছাড়া পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম নেয়াটাও নবীজির সুন্নাহ; তিনি রাতের একটি অংশ ঘুমাতেন এবং তাহাজ্জুদসহ ইবাদতও করতেন – অর্থাৎ ঘুম ও ইবাদতের সুন্দর ভারসাম্য রাখতেন। আজকের যুগে অনেকে দেরি রাত পর্যন্ত জেগে থাকে ও সকালে ক্লান্ত থাকে – এটা সুন্নাহসম্মত নয়। সঠিক সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং ভোরে উঠে দিন শুরু করা শারীরিক সুস্থতার জন্য অত্যন্ত উপকারী। হাদীসে এসেছে, নবীজি দোয়া করেছেন: “হে আল্লাহ, আমার উম্মতের সকালে বরকত দান করুন” – অর্থাৎ দিনের শুরুটা তাড়াতাড়ি করলে তাতে বরকত ও সফলতা বেশি মিলে। তাই রাতের অলসতা বাদ দিয়ে ভোরবেলা পড়াশোনা বা কাজের প্রস্তুতি নিন – দেখবেন দিনভর শক্তি ও কর্মস্পৃহা বজায় থাকবে।
- ব্যায়াম ও শারীরিক সক্ষমতা: একজন মুমিনের শক্ত-সমর্থ হওয়া ভালো – যেমন পূর্বোক্ত হাদীসে বলা হয়েছে শক্তিশালী মুমিন দুর্বল মুমিনের চেয়ে উত্তম। নবীজির যুগে সরাসরি জিম ছিল না, কিন্তু তিনি ঘোড়দৌড়, তিরন্দাজি, সাঁতার ইত্যাদি ক্রীড়ায় সাহাবীদের উৎসাহিত করেছেন। তিনি নিজেও সাহাবীদের সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা দিয়েছেন, কুস্তি লড়েছেন (প্রসিদ্ধ কুস্তিগীর রুকানাকে পরাজিত করেন), যা থেকে প্রমাণিত হয় যে তিনি শারীরিক ব্যায়ামকে উৎসাহিত করতেন। আমরা আধুনিক জীবনে অফিসের চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে নিস্তেজ হয়ে যাই – তাই সুন্নাহ অনুযায়ী ফিজিক্যাল অ্যাকটিভিটি বাড়াতে হবে। জগিং, ব্যায়াম, হাঁটা বা সাইক্লিং – যেটাই করেন, সুস্থতার উদ্দেশ্যে নিয়মিত করুন। নবীজি বলেছেন, “তোমার দেহেরও তোমার ওপর অধিকার আছে” – তাই শরীরকে সুস্থ রাখা এবং অতিরিক্ত চাপ না দেয়াও ইবাদত। সপ্তাহে কয়েকদিন পার্কে হাঁটা বা পরিবারের সাথে খেলাধুলা করার মাধ্যমে সুস্থতার সুন্নাহ রক্ষা করতে পারেন।
- রোগ-বালাই ও চিকিৎসা: মানুষ অসুস্থ হতেই পারে, তবে সুস্থতার জন্য চেষ্টা করা সুন্নাহ। রাসূল (সা.) বলেন, “আল্লাহ কোনো রোগ দেননি, যার প্রতিকার রাখেননি” (বুখারি) – অর্থাৎ চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত। নবীজির যুগে তিনি নিজে ও সাহাবীরা হারবাল ও প্রাকৃতিক চিকিৎসা গ্রহণ করতেন (যেমন কালিজিরা, মধু, হিজামা/শিঙ্গা ইত্যাদি প্রয়োগ করেছেন)। বর্তমান যুগে আধুনিক চিকিৎসা ও ওষুধ এসেছে, সেগুলোর সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নির্দিষ্ট কিছু পরামর্শও অনুসরণ করা যেতে পারে – যেমন রোগীর জন্য দোয়া করা, পানিপড়া/রুকইয়াহ করা ইত্যাদি। সুস্থ থাকার আরেকটি সুন্নতি পন্থা হলো মানসিক স্বস্তি অর্জন – হাদীসে আছে “কোনো বিপদ হলে ‘ইন্না লিল্লাহি…’ পড়বে এবং সবকিছুতে আল্লাহর তাকদীর মেনে নেবে”। স্ট্রেস বা দুশ্চিন্তা হলে মহানবী (সা.) দু’আ ও আল্লাহর যিকিরের মাধ্যমে হৃদয় শান্ত করতেন। আধুনিক মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য মেডিটেশন বা mindfulness বলা হয় – আমাদের জন্য সবচেয়ে ভাল mindfulness হল নিয়মিত সালাত আদায় ও তিলাওয়াত-যিকির করা, যা অন্তরে প্রশান্তি এনে দেয় (কুরআন ১৩:২৮)।
সব মিলিয়ে, সুস্থ জীবন যাপনের জন্য সুন্নাহর মূলমন্ত্র হল – পরিমিতি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, শরীরচর্চা ও আল্লাহর উপর ভরসা রাখা। নবীজির জীবনধারা ছিল অতি সাদাসিধে কিন্তু ভারসাম্যপূর্ণ: তিনি ভালো-পুষ্টিকর খাবার খেতেন কিন্তু কখনো পেটভরে খেতেন না; তিনি ইবাদতে আন্তরিক ছিলেন কিন্তু অকাতরে শরীরকে ক্লান্ত করতেন না; তিনি আনন্দ করতেন বৈধ উপায়ে এবং বিশ্রাম নিতেন যথাসময়ে। এই সুন্নতিগুলো অনুসরণ করলে আমাদের স্বাস্থ্য ঠিক থাকার পাশাপাশি ইবাদত ও দায়িত্বগুলোও সুন্দরভাবে পালন করতে পারবো ইনশাআল্লাহ।
সময় ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলায় সুন্নাহ
সময় হলো আমাদের জীবনের পুঁজি। আধুনিক যুগের বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হল কার্যকরভাবে সময় ব্যবস্থাপনা করা – কাজ, পরিবার, ইবাদত ও বিশ্রামের মধ্যে ভারসাম্য রাখা। মহানবী (সা.) এর জীবন থেকে আমরা আদর্শ সময়ব্যবস্থাপনার উদাহরণ পাই। তিনি জীবনের প্রতিটি মূহূর্ত কাজে লাগিয়েছেন এবং অন্যদেরও সময়ের মূল্য বুঝিয়েছেন। একটি প্রসিদ্ধ হাদীসে নবীজি উপদেশ দেন: “পাঁচটি জিনিসকে অপর পাঁচটির পূর্বে গনিমত (সুযোগ) জেনে নাও: বার্ধক্যের পূর্বে তোমার যৌবন, অসুস্থতার পূর্বে তোমার সুস্থতা, দরিদ্রতার পূর্বে তোমার স্বচ্ছলতা, ব্যস্ততার পূর্বে তোমার অবসর, মৃত্যুর পূর্বে তোমার জীবনকে মূল্যায়ন করো”। এই মহান আদর্শকে বাস্তবে কাজে লাগাতে কিছু সুন্নতী পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়:
- শুরুতেই দিনের কাজ পরিকল্পনা করা: নবীজি সকালে ঘুম থেকে উঠেই আল্লাহর নাম নিয়ে নতুন দিনের সূচনা করতেন এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো নিয়মিত ধারাবাহিকতায় সম্পন্ন করতেন। আমরা যদি প্রতিদিন সকালে বা আগের রাতে দিনের করণীয় কাজগুলোর একটি তালিকা করি (To-Do list), তবে সময় নষ্ট কম হবে। ইসলাম চায় না যে মুমিন তার সময় এলোমেলোভাবে নষ্ট করুক; বরং সকালে ফজরের পর অলসভাবে ঘুমিয়ে না থেকে সক্রিয় হওয়া সুন্নাহ। সকালের সময়টুকু সবচেয়ে বরকতময় – পড়াশোনা, কাজের প্রস্তুতি, কিংবা পরিবারের সাথে সময় – যে দিকেই ব্যয় করবেন, সেটিতে সফলতা আসার সম্ভাবনা বেশি। পরিকল্পনাহীনভাবে দিন শুরু করলে অনেক সময় অপচয় হয়ে যায়, তাই সুন্নতের অনুসরণে সুশৃঙ্খল রুটিন বানিয়ে নিজেকে পরিচালিত করুন।
- প্রথমে গুরুত্বপূর্ণ ও ফরজ কাজগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া: নবীজির শিক্ষা হল, গুরুত্বপূর্ণ কাজ বিলম্ব না করে যথাসময়ে সম্পন্ন করা। যেমন নামাজের সময় হলে সাথে সাথে নামাজ আদায় করতেন, যেটি আমাদের শিখিয়ে যায় যে প্রতিটি কাজের নিজস্ব উত্তম সময় আছে। আপনাকে যদি একদিকে অফিসের ডেডলাইন আরেকদিকে পরিবারের দরকার এবং একইসাথে নামাজের সময় হয়ে যায় – তখন সুন্নাহর অনুসারী হয়ে ফরজ নামাজটাকে সবার আগে রাখুন। এরপর যেটি জরুরি, সেটি করুন। এভাবে ফরজ, ওয়াজিব দায়িত্ব আগে এবং গৌণ কাজ পরে – এই নীতি কার্যকর করুন। আধুনিক ‘time management’ তত্ত্বেও “prioritize your tasks” বলা হয়, যা আসলে নবীজিরই সুন্নাতি শিক্ষা। উদাহরণস্বরূপ, সকালে অফিসে গিয়ে প্রথমে সবচেয়ে কঠিন কাজটি সম্পন্ন করুন (একে ‘eat that frog’ও বলে) – তাহলে বাকি সময়টায় চাপ কমে যাবে এবং কাজগুলো সহজ হবে। মোটকথা, গুরুত্বপূর্ণ কাজকে পেছনে ফেলে সময় নষ্ট করা সুন্নাহবিরুদ্ধ; বরং “যা তোমার উপকারে আসবে, তাতে দৃঢ় থাক এবং আল্লাহর সাহায্য চাই” – হাদীসের এই নির্দেশনা মানতে হবে।
- সময় নষ্টকারী বিষয়ে সংযম: আমাদের সময় ছিনিয়ে নেয় এমন অভ্যাসগুলো পরিহার না করলে কোনো পরিকল্পনাই কার্যকর হবে না। সোশ্যাল মিডিয়া অতিরিক্ত ব্যবহারের বিষয়টি আগেই আলোচিত হয়েছে। এছাড়াও টেলিভিশন সিরিয়াল, অপ্রয়োজনীয় আড্ডা, অতিরিক্ত ঘুম প্রভৃতি কমিয়ে আমরা সময় বাঁচাতে পারি। নবীজি অনর্থক কাজ পছন্দ করতেন না; হাদীসে আছে: “কারো ইসলামের সৌন্দর্যের অংশ হলো অনর্থক বিষয় ত্যাগ করা” (তিরমিজি)। তাই সুন্নাহর অনুসরণে নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন – দিনশেষে আমি কতক্ষণ অর্থহীন কাজে ব্যয় করছি? যদি দেখেন অনেকটা সময় ইউটিউবের রekomেণ্ডেড ভিডিও দেখে বা অনলাইনে সংবাদে স্ক্রল করে চলে যাচ্ছে, তাহলে সেটি কাটছাঁট করুন। অবসর বিনোদন নিশ্চয়ই আছে, তবে সেটি সীমিত করুন এবং নির্দিষ্ট সময়ে করুন। যেমন, ঠিক করলেন যে রাত ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত পরিবারের সাথে বিনোদনমূলক সময় দিবেন (টিভি/গেম ইত্যাদি), তারপর ১০টার পর থেকে ঘুমের প্রস্তুতি – এইভাবে সময়ের খাত নির্ধারণ করে দিলে অপচয় কমে আসবে।
- অবসর সময়কে সৎ কাজে লাগানো: কর্মব্যস্ততার ফাঁকে যেটুকু অবসর বা বিরতি মেলে, একজন মুসলিম তা অযথা নষ্ট না করে কল্যাণমূলক কিছু করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ট্রাফিকে আটকে আছেন ১৫ মিনিট – এখানে রাগ করা বা উদ্দেশ্যহীন ভাবার বদলে কিছু যিকির (সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ ইত্যাদি) করে নিন বা কুরআন তিলাওয়াত শুনে নিতে পারেন। দুপুরের খাবার সময় হলে খাওয়ার পরে ১০ মিনিট কুরআন পড়ুন বা একটি ইসলামিক নিবন্ধ পড়ে জ্ঞান বাড়ান। নবীজি বিরতি সময়গুলোতেও আল্লাহর স্মরণে থাকতেন। তিনি প্রতি সপ্তাহে জুমার দিন সূরা কাফ পড়ার তাগিদ দিয়েছেন – আজ আমরা যদি জুমা পর্যন্ত অপেক্ষা না করে দৈনিক কিছু কিছু কুরআন পড়ি, তাতে সপ্তাহান্তে পুরো সূরাটি পড়া হয়ে যাবে। মোটকথা, অবসর সময়কে হালকা ভাবে না দেখে এটিকে একটি “নেয়ামত” মনে করে কাজে লাগাতে হবে। এই অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে জীবনে অনেক বরকত সৃষ্টি হবে এবং বড় বিপর্যয় থেকেও বাঁচা যাবে।
- প্রতিদিনের জন্য আত্মসমালোচনা ও পরিকল্পনা পুনর্মূল্যায়ন: হযরত উমর (রা.) বলেছেন, “নিজেকে হিসাবের আগে হিসাব করো” – অর্থাৎ প্রত্যেকদিন শেষে নিজ কাজগুলোর ফিরিস্তি মাথায় বা ডায়েরিতে মিলিয়ে দেখা সুন্নতের অংশ হতে পারে। এতে আপনি বুঝতে পারবেন সময় কীভাবে ব্যয় হলো, কোথায় সময় অপচয় হয়েছে, আগামীকাল কীভাবে আরো ভালোভাবে সময় কাজ নিতে পারবেন। রাতে ঘুমানোর আগে নবীজি কিছু দোয়া পড়তেন এবং দিনের আমলের হিসাব নিতেন বলে বর্ণিত আছে। আমরাও ছোট্ট করে চিন্তা করতে পারি: আজকে কতটা কাজ প্রোডাক্টিভ হয়েছে? কোনো ফরজ বা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছুটে গেছে কি? যদি যায়, সাথে সাথে তওবা করে কাল সংশোধনের নিয়ত করি। আর ভালো কিছু সম্পন্ন হয়ে থাকলে আলহামদুলিল্লাহ বলি। এভাবে মুহাসাবার (আত্মমূল্যায়ন) সুন্নাহ জীবনে প্রয়োগ করলে আমাদের সময় ব্যবস্থাপনা ক্রমশ উন্নত হবে এবং আল্লাহর কাছে জবাবদিহির প্রস্তুতিও হবে।
সবশেষে, মনে রাখার মতো হাদীস হল: “কিয়ামতের দিন আদম সন্তানের পা এক স্থান থেকে নড়বে না যতক্ষণ পাঁচ প্রশ্নের জবাব না দিবে – তার عمر (জীবন) কীভাবে ব্যয় করেছে, যৌবনকাল কী কাজে ব্যয় করেছে, সম্পদ কোথা থেকে উপার্জন করেছে ও কোথায় ব্যয় করেছে, এবং অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ী আমল করেছে কিনা” (তিরমিজি)। এই হাদীস আমাদের শিখায় যে জীবনের প্রতিটি সময় ও সম্পদের জন্য জবাবদিহি আছে। তাই সুন্নাহ মোতাবেক সময়ের সদ্ব্যবহার করা শুধু দুনিয়াবী সাফল্যের জন্য নয়, পরকালের সফলতার জন্যও অপরিহার্য।
আধুনিক যুগের চ্যালেঞ্জের মধ্যে সুন্নাহ চর্চা করা কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু সত্য হলো – রাসূলুল্লাহ (সা.) এর শিক্ষা সর্বকালের জন্যই প্রযোজ্য এবং কল্যাণকর। ঘরের ভিতরে পারিবারিক জীবন হোক বা বাইরের কর্মক্ষেত্র, সামাজিক যোগাযোগের মাঠ হোক বা ব্যক্তিগত উন্নতির ক্ষেত্র – সর্বত্র ইসলাম আমাদের ভারসাম্যপূর্ণ ও নৈতিক জীবনযাপনের পথ দেখায়। নবীজির সুন্নাহর বাস্তব কৌশলগুলো ধীরে ধীরে জীবনে বাস্তবায়ন করলে আমাদের জীবন সহজতর ও বরকতময় হবে।
পরিবারে শান্তি, কর্মজীবনে সাফল্য, প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার, শারীরিক-মানসিক সুস্থতা এবং সময়ের মূল্যায়ন – এসব ক্ষেত্রে যদি আমরা ইসলামের নির্দেশনা মানি, তবে দ্বীন ও দুনিয়া দুটোতেই সফল হতে পারব। অবশ্যই, পরিবর্তন রাতারাতি আসবে না; তবে ছোট ছোট সুন্নত পালন দিয়ে শুরু করলে আল্লাহ তাআলা তাতে বড় Blessing (বরকত) দান করেন। প্রতিদিন একটু একটু করে রাসূল (সা.) এর আদর্শ অনুসরণের চেষ্টা করুন – সকালে উঠেই আল্লাহকে স্মরণ করা, বের হওয়ার আগে সুন্নত দোয়া পড়া, কাজে সততা বজায় রাখা, খাবারে পরিমিতি রাখা, রাতে ঘুমানোর আগে দিনের হিসাব করা – এ রকম অসংখ্য ছোট সুন্নত আপনার জীবনের মান বৃদ্ধি করবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি এনে দেবে।
পরিশেষে, মহানবী (সা.) এর এই দুআটি স্মরণে রাখি: “হে আল্লাহ! আমাদের পরিবার-পরিজন ও কাজে বরকত দিন এবং আমাদেরকে আপনার কিতাব ও সুন্নাহ অনুযায়ী জীবনযাপন করার তৌফিক দিন।” আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের ঘরে-বাইরে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের সৌন্দর্য বাস্তবে কর্মরূপ দিতে সাহায্য করুন। আমীন।