তৌহিদ: ইসলামের মূলমন্ত্র ও সমাজ পরিবর্তনের শক্তি
প্রারম্ভিক কথা
তৌহিদ হলো ইসলামের মূল ভিত্তি ও প্রাণকেন্দ্র। এর অর্থ হলো আল্লাহর একত্ববাদ, অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহই সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা এবং উপাস্য; তাঁর সঙ্গেই আমাদের সম্পূর্ণ একত্ব থাকতে হবে। কোনো শরিক, অংশীদার বা সমপর্যায়ী আল্লাহর নেই। এই বিশ্বাস ইসলামী জীবনের মূল দিকনির্দেশক এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবন ও সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তি।
তৌহিদের সামাজিক ও নৈতিক প্রভাব
যে পরিবারে ও সমাজে তৌহিদের সঠিক ধারণা ও চর্চা রয়েছে, সেখানে সম্মান, দায়িত্ববোধ, এবং ন্যায়পরায়ণতা বজায় থাকে। কারণ তৌহিদ মানুষের মনকে আল্লাহর কাছে গেঁথে দেয়, আর আল্লাহর সৃষ্টি প্রত্যেক মানুষ সমান মর্যাদার অধিকারী। এর ফলে বর্ণ, জাতি, সম্পদ বা সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতে মানুষকে অবমূল্যায়ন বা শোষণ করার স্থান থাকে না।
তৌহিদ সমাজে সমতা, ঐক্য ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠায় এক অদ্বিতীয় ভূমিকা পালন করে। শিরক ও কুসংস্কার মুক্ত সমাজে মানুষ একে অপরের প্রতি দয়া, শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা প্রদর্শন করে। এতে দুর্নীতি, অত্যাচার ও অবিচার কমে যায় এবং সুস্থ সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
কালিমা (তৌহিদের ঘোষণা) ও ইসলামী জীবন দর্শন
কালিমা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” (আল্লাহ ছাড়া উপাস্য নেই) হলো ইসলামের মূল ভিত্তি। এটি শুধু একটি বাক্য নয়, এটি এক সম্পূর্ণ জীবনদর্শনের ভিত্তি যার উপরই ইসলামী উম্মত গড়ে উঠেছে। আল্লাহর একত্ব বিশ্বাস না করলে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা অসম্ভব।
আল্লাহ তায়ালা কুরআনে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন—‘আইন-বিধান জারি করার অধিকার একমাত্র আল্লাহর। তাই তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারো পালনকর্তা বা উপাস্য হও না।’ (সূরা ইউসুফ, আয়াত ৪০)
ঈমান ও ইসলামের ভিত্তি
ইসলামের পাঁচ স্তম্ভ ও ঈমানের পাঁচ স্তম্ভের মধ্যে তৌহিদই মূল। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“ইসলামের স্তম্ভ পাঁচটি:
১. আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) তাঁর রাসূল;
২. নামাজ কায়েম করা;
৩. জাকাত দেওয়া;
৪. হজ সম্পাদন;
৫. রমজানের রোজা রাখা।”
ঈমানের রুকন (মূল ভিত্তি) দুটি—এক. তাগুত (আল্লাহবিরোধী যেকোনো কিছু) কে অস্বীকার করা; দুই. একমাত্র আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখা।
তৌহিদের গুরুত্ব ও সামাজিক কল্যাণ
তৌহিদ মানুষকে আল্লাহর প্রতি দায়িত্ববোধ ও সততা শেখায়। একজন তৌহিদি ব্যক্তি সর্বদা মনে রাখে যে, আল্লাহ সবকিছু দেখে, তাঁর নৈকট্য লাভের জন্যই সে সদাচরণ করবে। তাই সে ন্যায়পরায়ণ, সৎ ও দয়ালু হয়।
তৌহিদ সমাজ থেকে শোষণ ও বৈষম্য দূর করে এবং সমতা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে। সকল মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি, তাই কেউ আরেকজনের উপরে শ্রেষ্ঠ নয়, বরং সকলেই আল্লাহর দাস। এতে সামাজিক ঐক্য, পারস্পরিক সহযোগিতা ও শান্তি বজায় থাকে।
অতিরিক্ত গুরুত্বপূর্ণ দিকসমূহ
- তৌহিদ কুসংস্কার ও শিরক থেকে মুক্তি দেয়: শিরক (আল্লাহর সঙ্গী কোনো উপাস্য গ্রহণ) সর্বাগ্রে নষ্ট ও হারাম, যা ইসলামের মূলনীতির পরিপন্থী। তৌহিদই শিরকের বিরুদ্ধে শক্ত ভিত্তি গড়ে দেয়।
- তৌহিদ ঈমানদার ব্যক্তিত্ব গঠনে সাহায্য করে: এর ফলে ব্যক্তি যুক্তিবাদী, ধার্মিক ও সুস্থচিন্তাশীল হয়ে ওঠে।
- তৌহিদই ইসলামী নৈতিকতা ও আইন প্রণয়নের মূল: আল্লাহর একত্ব স্বীকার না করলে ইসলামী ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব।
- তৌহিদ ও ইসলামের ঐক্য: তৌহিদই মুসলিম উম্মতের ঐক্যের মূল ভিত্তি, যা বিভিন্ন মতবিরোধ ও গোঁড়ামি দূর করে।
উপসংহার
তৌহিদ হল ইসলামের প্রাণ ও মুসলিম জীবনের মৌলিক ভিত্তি। এটি শুধু আল্লাহর একত্ব বিশ্বাস নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন দর্শন যা আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের সব দিককে পরিচালিত করে।
আমাদের সকলের উচিত তৌহিদের এই মহত্ত্বকে বুঝে জীবনে মেনে চলা, পরিবার ও সমাজে এর শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়া। কারণ তৌহিদ ছাড়া ইসলামের পূর্ণতা অর্জন সম্ভব নয় এবং এর মাধ্যমে আমরা শোষণমুক্ত, ন্যায়পরায়ণ, ঐক্যবদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তুলতে পারব।
হে মুসলমানগণ!
আল্লাহর একত্বের প্রতি ঈমান আনুন এবং জীবন যাপন করুন এই বিশ্বাসের আলোকে। আল্লাহ তায়ালার আদেশে চলুন, শিরক থেকে বিরত থাকুন এবং সমাজে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করুন। তৌহিদই আমাদের মুক্তি ও কল্যাণের মূল চাবিকাঠি।