বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় সংগ্রাম তার নিজের নফস বা প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে। এই নফসই কখনো মানুষকে ভালো কাজের দিকে আহ্বান করে, আবার কখনো টেনে নেয় গোনাহের গভীরে। আর এই নফসকেই সংযত করাই হলো তাসাউফের প্রথম ও প্রধান ধাপ। কারণ, নফসের উপর নিয়ন্ত্রণই তাসাউফের দরজা খুলে দেয়।
🔍 নফস কী?
নফস হলো মানুষের ভিতরের সেই ঝোঁক বা প্রবৃত্তি, যা তাকে কাজ করতে প্ররোচিত করে — সেটা হোক ভালো কিংবা মন্দ। কুরআনে নফসকে তিনটি স্তরে উল্লেখ করা হয়েছে:
নফসে আম্মারা: যেটা সবসময় মন্দের দিকে টানে। (সূরা ইউসুফ: ৫৩)
নফসে লাওয়ামা: যেটা পাপের পর নিজেকে ভর্ৎসনা করে। (সূরা কিয়ামা: ২)
নফসে মুতমাইন্না: প্রশান্ত ও পরিশুদ্ধ নফস, যেটা আল্লাহর সন্তুষ্টিতে রত। (সূরা ফজর: ২৭-২৮)
তাসাউফ বা আত্মশুদ্ধির পথে যাত্রা শুরু হয় নফসে আম্মারা থেকে লাওয়ামা, এবং সেখান থেকে মুতমাইন্না’র দিকে উন্নীত হওয়ার মধ্য দিয়ে।
💠 তাসাউফ কী?
তাসাউফ হলো ইসলামি আত্মশুদ্ধির একটি শাখা, যেখানে একজন মুমিন নিজের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের পথ খোঁজেন। এটা কোনো আলাদা ধর্মীয় মতবাদ নয়, বরং কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে আত্মশুদ্ধির সাধনা।
হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (রহঃ) বলেছেন:
“তাসাউফ হলো, নিজের নফসের সাথে জিহাদ করা।”
🌪️ নফসের দাসত্ব বনাম নিয়ন্ত্রণ
একজন মানুষ যদি নিজের নফসের দাস হয়, তাহলে সে সহজেই গোনাহে জড়িয়ে পড়ে। তার চিন্তা, চাওয়া, আবেগ, সময় ও শক্তি — সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে নফসের খেয়াল। কিন্তু যে ব্যক্তি তার নফসকে নিয়ন্ত্রণ করে, সে-ই আত্মিক জিহাদে জয়ী হয় এবং আল্লাহর কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে।
আল্লাহ বলেন:
“যে ব্যক্তি নিজেকে (নফসকে) পরিশুদ্ধ করল, সে সফলকাম।”
— [সূরা শামস: ৯]
🧭 নফস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তাসাউফের পথে যাত্রা
১. মুহাসাবা (আত্মসমালোচনা)
প্রতিদিন নিজের দিনটি পর্যালোচনা করা — কোন কাজটা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হলো, আর কোনটা গোনাহ। আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নফসের ভুল ধরিয়ে দেওয়া হয়।
২. মুজাহাদা (অন্তরের জিহাদ)
নফসের বিপরীতে গিয়ে ইবাদত করা, অন্যের হক আদায় করা, রাগ সংবরণ করা — এগুলোই হলো নফসের বিরুদ্ধে প্রকৃত জিহাদ।
৩. খালওয়া (নিঃসঙ্গতা)
নফসের প্রলোভন থেকে মুক্ত থাকতে মাঝে মাঝে একাকীত্বে ইবাদত ও চিন্তামগ্ন হওয়া দরকার।
৪. জিকির ও ইস্তিগফার
নফসের অহংকার দূর করার জন্য নিয়মিতভাবে আল্লাহর জিকির, দরূদ শরীফ, ও ইস্তিগফার করা খুবই কার্যকর।
💎 সুফিগণের দৃষ্টিতে নফস
তাসাউফের বড় বড় বুযুর্গরা নফসকে বলেন “একটি রাক্ষুসে শিশু”, যেটাকে প্রশিক্ষণ না দিলে তা বড় হয়ে হালাল-হারামের পার্থক্য ভুলে যাবে।
হযরত শাইখুল আকবর ইবনে আরাবি (রহঃ) বলেন:
“নফস যখন দাস হয়, তখন হৃদয় রাজত্ব করে। আর নফস যখন রাজা হয়, তখন হৃদয় বন্দী হয়ে পড়ে।”
তাই তাসাউফ চর্চাকারীদের প্রথম শিক্ষা হলো — নফসকে চিনো, তারপর তাকে নিয়ন্ত্রণ করো।
📘 রাসূলুল্লাহ ﷺ এর শিক্ষা
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“মুজাহিদের প্রকৃত মুজাহিদ সে, যে নিজের নফসের সাথে জিহাদ করে।”
— [তিরমিজি, হাদীস: ১৬২1]
এই হাদীসই প্রমাণ করে, নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম একটি নিরব কিন্তু মহৎ যুদ্ধ। যারা এই যুদ্ধে জয়ী হন, তাঁরাই তাসাউফের মূল স্বাদ লাভ করেন।
🌷 নফস সংযমের ফলাফল
✅ অন্তরে প্রশান্তি আসে (নফসে মুতমাইন্না)।
✅ গোনাহের প্রতি ঘৃণা জন্মায়।
✅ আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
✅ মানুষ জিকির ও ইবাদতের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
✅ হৃদয় আলোকিত হয় হিকমা (প্রজ্ঞা) ও নূরে ইমান দ্বারা।
🧠 আত্মনিয়ন্ত্রণই আত্মমুক্তি
নফসকে সংযত না করলে মানুষ দুনিয়ার মোহে পড়ে যায়। আর যদি কেউ নফসকে দমন করতে পারে, তখন তার অন্তর হয়ে ওঠে আল্লাহর আরশের প্রতিফলন। সে দেখে, শোনে, বোঝে — সবকিছু আল্লাহর সন্তুষ্টির আলোকে। তাসাউফের মূল লক্ষ্যই এই আত্মার পরিশুদ্ধি।
🔚 উপসংহার
নফস একটি অভ্যন্তরীণ যুদ্ধক্ষেত্র। এই যুদ্ধের বিজয়ী তারাই হয়, যারা নিয়মিত আত্মসমালোচনা, ইবাদত, জিকির ও আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিজের নফসকে সংযত করে।
আর সেই নিয়ন্ত্রণের ফলেই খুলে যায় তাসাউফের দরজা — যেখানে রয়েছে আল্লাহর নৈকট্য, প্রশান্তি, হিকমা এবং আত্মার মুক্তি।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে নফসের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে তার একজন প্রিয় বান্দা হিসেবে কবুল করুন।
আমীন।