তরুণদের মন প্রশ্নে ভরা। তারা চোখে দেখে, কানে শোনে, মগজে ঘুরপাক খায়। কিন্তু উত্তর চায় হৃদয়ের ভাষায়। এই লেখাটি সেই তরুণদের জন্য—যারা দ্বীনের দিকে ফিরতে চায়, কিন্তু প্রশ্নের ভারে নুয়ে পড়ে। আসুন, সরাসরি বলি। সাদাসিধে ভাষায়। যুক্তি দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে, আলো দিয়ে।
প্রশ্ন ১: আল্লাহকে তো দেখা যায় না। তাহলে কীভাবে বিশ্বাস করব?
উত্তর: তুমি কি তোমার মস্তিষ্ককে দেখেছো? হৃদপিণ্ডকে? ভালোবাসাকে? তবু তুমি জানো—এগুলো আছে। আল্লাহকে দেখা যায় না, কিন্তু তাঁর অস্তিত্ব সর্বত্র ছড়িয়ে। এমনকি নিজের ভেতরেও। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, “তোমাদের নিজেদের মধ্যেও রয়েছে (আমার নিদর্শন); তবুও কি তোমরা দেখো না?” (সূরা যারিয়াত: ২১)
একটি বই যদি লেখক ছাড়া না হয়, একটি ঘড়ি যদি নির্মাতা ছাড়া না চলে—তবে এই নিখুঁত বিশ্বজগৎ, তোমার চোখ, হৃদয়, আত্মা কি নিছক কাকতালীয়?
আল্লাহ বলেন: “আমি আমার নিদর্শন দেখাবো তাদের চারপাশে এবং নিজেদের মধ্যে, যতক্ষণ না তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে এটি সত্য।” (সূরা ফুস্সিলাত: ৫৩)
চোখে না দেখা মানেই অস্তিত্বহীন—এই যুক্তি বস্তুবাদীদের, চিন্তাশীলদের নয়।
প্রশ্ন ২: ইসলামে এত নিয়ম-কানুন কেন? জীবন কি বন্দি হওয়ার জন্য?
উত্তর: জীবন বন্দিত্ব নয়, দায়িত্ব। যেমন নদীর জন্য বাঁধ মুক্তি দেয় না, বরং দিশা দেয়—তেমনি ইসলাম নিয়ম দিয়ে জীবনকে সুশৃঙ্খল করে। ইসলামের বিধিনিষেধ নিছক নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং রক্ষা ও পরিশুদ্ধি। মহান মনিব ইরশাদ করেন, “আল্লাহ চান না তোমাদেরকে কষ্ট দিতে, বরং তিনি চান তোমাদেরকে পরিশুদ্ধ করতে।” (সূরা মায়িদা: ৬)
মদ হারাম, কারণ:
“তাতে আছে বড় গোনাহ ও মানুষের জন্য কিছু উপকার, কিন্তু তার গোনাহ উপকার অপেক্ষা বড়।” (সূরা বাকারা: ২১৯)
যিনা হারাম, কারণ:
“এটা অশ্লীলতা এবং খুবই নিকৃষ্ট পথ।” (সূরা বনি ইসরাইল: ৩২)
এগুলো থেকে বাঁচিয়ে আল্লাহ আমাদের পবিত্রতা ও মর্যাদা দেন।
প্রশ্ন ৩: সব ধর্মই তো ভালো কথা বলে। ইসলাম কেন আলাদা?
উত্তর: ভালো কথা বলাই শেষ কথা নয়—সত্য পথ কোনটি, সেটাই আসল প্রশ্ন।
ইসলাম একমাত্র ধর্ম,
- যার গ্রন্থ অবিকৃত (সূরা হিজর: ৯),
- যার রাসূল শেষ ও চূড়ান্ত (সূরা আহযাব: ৪০),
- এবং যার শিক্ষা সম্পূর্ণ ও সর্বজনীন (সূরা মায়িদা: ৩, সূরা সাবা: ২৮)।
আল্লাহ সুবহানু তা’য়লা বলেন, “আজ আমি তোমাদের জন্য দ্বীনকে পূর্ণ করলাম, আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম।” (সূরা মায়িদা: ৩)
যে ধর্ম কেবল মন্দ কাজ থেকে বাঁচায় না, বরং জীবনের প্রতিটি স্তরে পরিশুদ্ধি আনে—তা-ই একমাত্র সত্য ধর্ম। ইসলাম সেই আল্লাহ-নিযুক্ত সত্য জীবনব্যবস্থা।
প্রশ্ন ৪: আমি আল্লাহকে মানি, কিন্তু ধর্ম মানি না। এটা কি যথেষ্ট?
উত্তর: আল্লাহকে মানা মানেই তাঁর কথা মানা। তাঁর পাঠানো রাসূলকে মানা। তাঁর বিধান মানা—এটিই প্রকৃত ‘আল্লাহ-ভক্তি’। “বলুন: যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমাকে অনুসরণ করো—আল্লাহও তোমাদের ভালোবাসবেন।” (সূরা আলে ইমরান: ৩১)
আর রাসূল (সা.) বলেন: “যে আমার আদেশ মানে না, সে আমার উম্মত নয়।” (সহীহ মুসলিম)
তুমি যদি প্রেমিক হও, প্রিয়জনের কথা অমান্য করতে পারো?
প্রশ্ন ৫: আমার অতীতে অনেক ভুল আছে। এখন বদলালেও কি আল্লাহ গ্রহণ করবেন?
উত্তর: তোমার ফিরে আসাটাই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়। তুমি যদি তওবা করো, তবে আল্লাহ অতীত সব মুছে দেবেন। শুধু তাই নয়—তাঁর দয়ার দরজা তোমার জন্য আগেও খোলা ছিল, এখনো আছে। “যে তওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে—আল্লাহ তাদের গোনাহগুলো পুণ্যে রূপান্তর করবেন।” (সূরা ফুরকান: ৭০)
“আল্লাহ তওবাকারীদের ভালোবাসেন।” (সূরা বাকারা: ২২২)
নবীজি বলেন:
“তওবাকারী এমন, যেন সে কোনো পাপই করেনি।” (ইবন মাজাহ)
তোমার যাত্রা শেষ হয়ে যায়নি—এটাই নতুন শুরু।
প্রশ্ন ৬: ইসলাম কি নারীদের সীমাবদ্ধ করে না?
উত্তর: না। ইসলাম নারীকে সীমাবদ্ধ করেনি, বরং সুরক্ষা, মর্যাদা ও অধিকার দিয়েছে—যা আগে কোনো সভ্যতা দেয়নি। নারী প্রথমবারের মতো স্বতন্ত্র সম্পত্তির অধিকার, বিবাহে সম্মতি, শিক্ষা ও উত্তরাধিকার পেয়েছে ইসলামে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে,
“তোমাদের কারো কাজ হারিয়ে যাবে না—পুরুষ হোক, নারী হোক; তোমরা একে অপরের অংশ।” (সূরা আলে ইমরান: ১৯৫)
রাসূল (সা.) বলেছেন:
“যে কন্যাসন্তানদের লালনপালন করে, সে জান্নাতে আমার সঙ্গী হবে।” (সহীহ মুসলিম)
পর্দা নিপীড়ন নয়—মর্যাদার পোশাক। যার চেহারায় নয়, চরিত্রে সৌন্দর্য।
প্রশ্ন ৭: আমার বন্ধুরা নামাজ পড়ে না। আমি একা পড়ে কী লাভ?
উত্তর: নামাজ একটি ব্যক্তিগত দায়। বন্ধুরা পড়ে না—তাই না পড়া, এটি কেবল দুর্বলতার অজুহাত। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, “প্রত্যেক ব্যক্তি তার কৃতকর্মের জন্য দায়ী।”(সূরা মুদ্দাসসির: ৩৮)
হাদীস শরীফে এসেছে, “নামাজ কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম হিসাব হবে।” (তিরমিজি)
তুমি হয়তো একা, কিন্তু আল্লাহ তোমার সঙ্গে। তোমার নামাজই একদিন তোমার বন্ধুকেও জাগিয়ে তুলবে।
প্রশ্ন করতে শেখো। কিন্তু উত্তর পাওয়ার পর পালিয়ে যেও না। কারণ ইসলাম কোনো অন্ধ বিশ্বাস নয়, বরং বুদ্ধি, অনুভব ও অনুশীলনের সমন্বয়ে গঠিত জীবনের শুদ্ধতম দিশা। ইসলাম প্রশ্নকে ভয় পায় না, কারণ সত্য কখনো প্রশ্নের কাছে হারে না। যারা আল্লাহকে খোঁজে, তাঁরা পেয়েই যায়। “তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব।” (সূরা গাফির: ৬০)
রেফারেন্সসমূহ:
- সূরা গাশিয়া: ১৭
- সূরা যারিয়াত: ২০–২১
- সূরা আহকাফ: ৩
- সূরা ফুস্সিলাত: ৫৩
- সূরা মায়িদা: ৬, ৩
- সূরা বনি ইসরাইল: ৩২
- সূরা বাকারা: ২১৯, ২২২
- সূরা আলে ইমরান: ৩১, ১৯৫
- সূরা হিজর: ৯
- সূরা সাবা: ২৮
- সূরা নূর: ৫৫
- সহীহ মুসলিম: তওবা, নামাজ
- ইবন মাজাহ: কিতাবুজ-যুহদ
- তিরমিজি: সালাত অধ্যায়
- সূরা মুদ্দাসসির: ৩৮
- সূরা গাফির: ৬০