বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আশা ও আকাঙ্ক্ষা দিয়ে জীবন যাপন করাকে ইসলাম কখনো নিষেধ করেনি, কিন্তু কেবল এই ভিত্তিতে জীবন পরিচালনা করাকে প্রজ্ঞা বলা যায় না। কারণ এই বিশ্বজগত শৃঙ্খলা ও প্রজ্ঞার ওপর দাঁড়িয়ে। ইসলাম—যা ফিতরাত তথা মানব প্রকৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা—আমাদের শুধুমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে নয়, বরং চিন্তা, প্রস্তুতি, কৌশল ও কর্মের সমন্বয়ে জীবন গঠন করতে বলে। এটি তাওয়াক্কুলের প্রকৃত রূপ, যেখানে ঈমান আর আমল একাকার হয়ে যায়।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন:
ڤ وَ اَعِدُّونَّ لَهُمْ مِنْ قُوَّةِ وَ مِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ… — [সুরা আনফাল: ৬০]
এই আয়াতে শুধু যুদ্ধের প্রস্তুতির কথাই বলা হয়নি, বরং জীবনের সকল ক্ষেত্রে সক্ষমতা অর্জনের নির্দেশনা রয়েছে। বিশ্বাস, আখলাক, রাজনীতি, অর্থনীতি, বাণিজ্য, শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে শক্তিশালী হওয়া ইসলামের একটি মৌলিক শিক্ষা। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়।”
সুন্নি তাওয়াক্কুল: বিশ্বাস ও কর্মের সমন্বয়
সুন্নি আকিদায় তাওয়াক্কুল মানে কেবল হাত গুটিয়ে বসে থাকা নয়; বরং সকল প্রস্তুতি গ্রহণের পর হৃদয়কে আল্লাহর উপর সোপর্দ করা। নবী মুহাম্মদ (সা.) নিজের যুদ্ধের জন্য কৌশল নির্ধারণ করতেন, সৈন্য সংখ্যা গুনতেন, সরঞ্জাম প্রস্তুত করতেন, তারপর আল্লাহর সাহায্য চাইতেন। সাহাবিরা ছিলেন চূড়ান্ত ঈমানদার, আবার তাঁরাই ছিলেন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, বিজ্ঞানী ও দানশীল। এটাই সুন্নাহর বাস্তব রূপ।
আজকের বাস্তবতা: ঈমান দুর্বলতা ও জ্ঞানচর্চার শৈথিল্য
আজ মুসলিম উম্মাহর দুর্বলতা আমাদের ঈমান ও কর্ম উভয়ের ক্ষেত্রেই স্পষ্ট। আমরা পরম করুণাময়ের শক্তিতে বিশ্বাস করি, অথচ নিজেরা দুর্বলতার মধ্যে দিন কাটাই। ইসরাইলি বর্বরতা, ফিলিস্তিনে গণহত্যা, মুসলিম নারীদের অপমান—এই সবই আমাদের বাস্তব শক্তির অভাব ও বিভাজিত অবস্থানের ফল।
মাদ্রাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান: আত্মসমালোচনা ও সংস্কারের প্রয়োজন
ইসলামী মাদ্রাসা হলো ইসলামের দুর্গ, কিন্তু অনেকক্ষেত্রে সেগুলো আত্মকেন্দ্রিকতা, দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক মুনাফার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। যেখানে ধর্ম শিক্ষা লাভকারী ছাত্ররা ভবিষ্যতে উপার্জনে সক্ষম হন না, সেখানে বাস্তব জীবনের সাথে disconnect তৈরি হয়। ইসলাম এমন শিক্ষা চায় না যা শুধু কিতাবি জ্ঞান দেয়, বাস্তব জীবন গঠনে অক্ষম রাখে।
ভণ্ড পীর ও মুনাফিক আলেম
আজকের আরেক বিপর্যয় হলো ভণ্ড পীর ও মুনাফিক আলেমদের আবির্ভাব, যারা তাসাউফ বা শরীয়তের নাম ব্যবহার করে সহজ-সরল মুসলমানদের ধোঁকা দেয়। তারা বাহ্যিক পোষাক ও শব্দচয়ন দিয়ে ধর্মীয় বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। সুন্নি তরিকায় এমন প্রতারণার কোনো স্থান নেই। তাই সুন্নি সমাজকে সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে।
সুন্নি জাগরণের পথে করণীয়
১. শক্তিশালী ঈমান ও আমল: শুধুমাত্র বাহ্যিক আচার নয়, বরং হৃদয়ের গভীর থেকে আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলা।২. জ্ঞানার্জনের মান উন্নয়ন: জ্ঞান শুধু চাকরির জন্য নয়, বরং উম্মাহ ও মানবতার কল্যাণে ব্যবহৃত হওয়া চাই।
৩. প্রযুক্তিতে অগ্রসর হওয়া: বিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রে মুসলিমদের সক্রিয় অংশগ্রহণ দরকার। পারমাণবিক শক্তি, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, পরিবেশ, মহাকাশ—সবখানে মুসলমানদের অবদান থাকা উচিত।
৪. নৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তোলা: নেতৃত্বের আসনে এমন ব্যক্তিদের প্রয়োজন যাঁরা আল্লাহভীরু, সাহসী ও দূরদর্শী।
৫. আত্মশুদ্ধি ও তাসাউফ: সত্যিকারের তাসাউফ মানে নফসের সংযম, মানুষের সেবা ও আধ্যাত্মিক উন্নতি।
উপসংহার
সুন্নি দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামের সেই ভারসাম্যপূর্ণ রূপ তুলে ধরে, যেখানে ঈমান কেবল অন্তরের নয়, বরং বাহ্যিক দায়িত্ব ও কর্মের সাথে যুক্ত। আজ মুসলিম উম্মাহকে দরকার আত্মসমালোচনা, শুদ্ধি, ঐক্য ও দূরদর্শিতা। আমাদের উচিত ধর্মীয় অনুভূতি ও বাস্তবিক শক্তিকে একত্র করে এমন একটি সমাজ গঠন করা, যা ইসলাম ও মানবতার জন্য কল্যাণকর হবে। ইসলাম আমাদের দোয়ার পাশাপাশি প্রস্তুতি ও পরিকল্পনার নির্দেশ দিয়েছে। তাই আসুন, আমরা সুন্নাহর আলোকে নিজেদের গড়ে তুলি — ঈমান, জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও কর্মে শক্তিশালী মুমিন হয়ে।
হে আল্লাহ! আমাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা দান করুন, আমীন।