আল-কুরআন শিক্ষা: প্রতিটি মুসলমানের জন্য এক অপরিহার্য দায়িত্ব
মানুষকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে অসংখ্য নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাদের মাধ্যমে নাযিল করেছেন গাইডবুকস্বরূপ সহীফা ও কিতাব। এসব কিতাবসমূহের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বশেষ এবং সংরক্ষিত কিতাব হল আল-কুরআন। এই কিতাব বিশ্বমানবতার জন্য হিদায়াতের একমাত্র আলো এবং মুসলমানদের জন্য জীবনের পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন।
আল-কুরআনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
আল্লাহ তাআলা বলেন:
“রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদের্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে।” — (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৫)
আল-কুরআন এমন একটি কিতাব যা শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির হিদায়াত ও কল্যাণের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। এটি আল্লাহর কালাম, যেটির তিলাওয়াত, অধ্যয়ন ও শিক্ষাদান সকল মুসলমানের ওপর ফরজ বা আবশ্যক কর্তব্য।
কুরআন শিক্ষা করা ফরজ
আল-কুরআনের প্রথম আয়াতেই রয়েছে শিক্ষা ও পাঠের নির্দেশনা:
“পড়ো, তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।” — (সূরা আলাক, আয়াত: ১)
হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ।” — (ইবনে মাজাহ)
“তোমরা কুরআন ও ফারায়েজ শিক্ষা করো এবং মানুষকে শিক্ষা দাও; কেননা আমাকে পৃথিবী থেকে তুলে নেওয়া হবে।” — (তিরমিযী)
কুরআন শিক্ষা: সর্বোত্তম ইবাদত
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই ব্যক্তি, যে নিজে কুরআন শেখে এবং অন্যকে শেখায়।” — (বুখারী)
“যে ব্যক্তি কুরআন পড়ে এবং তাতে দক্ষ, সে সম্মানিত ফেরেশতাদের সঙ্গে থাকবে। আর যে কষ্ট সহকারে কুরআন পড়ে, তার জন্য দ্বিগুণ সওয়াব।” — (বুখারী)
“যে ব্যক্তি কুরআন পড়বে, তা হিফজ করবে এবং হালালকে হালাল, হারামকে হারাম জানবে, সে জান্নাতে যাবে এবং তার মাধ্যমে আল্লাহ তার ১০ জন আত্মীয়কে মুক্তি দেবেন।” — (তিরমিযী)
কুরআনের প্রতি অবহেলা: ভয়ানক পরিণতি
“যার অন্তরে কুরআনের কিছুই নেই, সে যেন ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘর।” — (তিরমিযী)
বর্তমানে মুসলিম ঘর, দোকান ও মসজিদে কুরআনের তিলাওয়াতের আওয়াজ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। এর স্থানে গান-বাজনা, অবৈধ বিনোদন এবং অলসতা স্থান করে নিচ্ছে। অথচ কুরআনের তিলাওয়াত ছিল মুসলিম ঘরের পরিচয়। কুরআন তিলাওয়াত করা যেমন ইবাদত, তেমনি কুরআন শুনাও এক বিরাট সওয়াবের কাজ:
“যে ব্যক্তি কুরআনের একটি আয়াত মনোযোগ সহকারে শুনে, তার জন্য একটি দ্বিগুণ নেকি লেখা হয়। আর যে তা পাঠ করে, তা কিয়ামতের দিন তার জন্য আলো হবে।” — (মিশকাত)
সুন্নি দৃষ্টিভঙ্গিতে কুরআনের মর্যাদা
সুন্নি আকীদা অনুযায়ী, কুরআন আল্লাহর কালাম, যা অমর, অপরিবর্তনীয় এবং কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষিত। এটি হেদায়াতের চূড়ান্ত মাপকাঠি। কেউ যদি কুরআন বাদ দিয়ে অন্য কোথাও হিদায়াত খোঁজে, সে অবশ্যই গোমরাহ (পথভ্রষ্ট)।
“যে ব্যক্তি কুরআন ব্যতীত অন্য কোথাও হিদায়াত অন্বেষণ করবে, আল্লাহ তাকে গোমরাহ করে দেবেন।” — (তিরমিযী)
ইমাম আবু হানিফার কুরআনের প্রতি শ্রদ্ধা
ইমাম আযম আবু হানিফা (রহ.) ছিলেন কুরআন প্রেমিক। একবার তাঁর পুত্র কুরআনের প্রথম পাঠ শুরু করলে শিক্ষককে তিনি পাঁচ হাজার দিরহাম হাদিয়া দেন। সূরা ফাতিহা শেষ করায় আবারও পাঁচ হাজার দিরহাম দেন এবং বলেন, “এর চেয়ে বেশি থাকলে আরও দিতাম।” এটি বোঝায় যে, আলেমদের ও কুরআনের শিক্ষকের প্রতি কতটা সম্মান থাকা উচিত।
পরিবার ও সমাজে কুরআন শিক্ষার ব্যবস্থা
- প্রতিটি মুসলিম পরিবারে কুরআন শিক্ষার পরিবেশ গঠন করতে হবে।
- ছেলেমেয়েদের ছোটবেলা থেকেই মক্তবে পাঠানো আবশ্যক।
- প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য কুরআন শিক্ষা ক্লাস চালু করতে হবে।গ্রামে-গঞ্জে মক্তব ও হিফজখানা প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষার ব্যবস্থা করা জরুরি।যারা আর্থিকভাবে অক্ষম, তাদের সহায়তা করতে সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে।
- উপসংহার
আল-কুরআন শুধুই একটি ধর্মীয় গ্রন্থ নয়; এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত এক অপার হিদায়াত, যা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে আলোকিত করে। মুসলমান হিসেবে আমাদের জন্য কুরআনের প্রতি দায়িত্ববান হওয়া, শিক্ষা গ্রহণ করা, শিক্ষা দেওয়া এবং এর আলোকে জীবন পরিচালনা করা অপরিহার্য। এর মাধ্যমে আমরা দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা অর্জন করতে পারি।
اللَّهُمَّ اجْعَلِ القُرْآنَ رَبِيعَ قُلُوبِنَا، وَنُورَ صُدُورِنَا، وَذَهَابَ أَحْزَانِنَا
আল্লাহ আমাদের সবাইকে কুরআনের আলোয় আলোকিত জীবন যাপন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।