ইসলাম ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আখিরাতের বিশ্বাস। আখিরাত শব্দের অর্থ “শেষ দিন” বা “পরকালের জীবন,” যা এই পৃথিবীর মৃত্যুর পরের অনন্ত জীবনকে নির্দেশ করে। সুন্নি দৃষ্টিভঙ্গিতে আখিরাতের প্রতি ঈমান আনাটা ঈমানের অন্যতম মূল ভিত্তি এবং ইসলামের পাঁচটি মূল বিশ্বাসের (আরকানুল ঈমান) একটি অপরিহার্য অংশ।
আখিরাতের ধারণা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস মুসলিম জীবনের মৌলিক অনুপ্রেরণা। এটি শুধু একটি বিশ্বাস নয়, বরং মানুষের দৈনন্দিন জীবন ও কাজের মাপকাঠি। যেহেতু এই পৃথিবীতে আমাদের জীবন অস্থায়ী, তাই আখিরাতের জীবন চিরস্থায়ী ও প্রকৃত জীবন। সুন্নি মুসলমানরা বিশ্বাস করে, এই জীবন হলো পরীক্ষার ময়দান, যেখানে আমাদের কাজ-ক্রিয়া ও মনোভাব অনুসারে পরকালে বিচার হবে।
আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেন:
“যে ব্যক্তি পৃথিবীতে কাজ করেছে—সৎ বা দুষ্ট—সেই তার ফল পাবে, এবং সে নির্দোষ থাকবে না।” (সূরা আল-জাজিয়া, আয়াত ২২)
আখিরাতের মূল বিশ্বাসসমূহ
সুন্নি ইসলামের শিক্ষায় আখিরাত সম্পর্কে বেশ কিছু স্পষ্ট ও মৌলিক বিশ্বাস বিদ্যমান, যেগুলো ঈমানের অংশ:
১. মৃত্যুর পর জীবনের অস্তিত্ব:
মৃত্যু পৃথিবীতে জীবনের সমাপ্তি, কিন্তু আখিরাতে মানুষের প্রকৃত জীবন শুরু হয়। মৃত্যু একটি বাস্তবতা, এবং মানুষ তার পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুত থাকতে বাধ্য।
২. কিয়ামত বা পরকালের বড় দিন:
একদিন আল্লাহর ইচ্ছায় এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত সৃষ্টির সমাপ্তি ঘটবে, এটিই কিয়ামত। সেই দিনে সব মানুষ জীবিত হবেন এবং তাদের কাজের বিচারে দাঁড়াবেন।
৩. হিসাব ও বিচারের দিন:
কিয়ামতের দিন প্রত্যেকের সোনালী ও কালো আমল নথি (আমলনামা) হাজির করা হবে। আল্লাহ তা’আলা ন্যায়বিচার করবেন সবার কাজের উপর। যারা সৎ কাজ করেছে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যারা অন্যায় করেছে তারা জাহান্নামে যাবেন।
৪. জান্নাত ও জাহান্নাম:
আল্লাহ তায়ালা বর্ণনা করেছেন দুটো চিরন্তন আবাসস্থল—জান্নাত (স্বর্গ), যেখানে প্রতিদিনের আনন্দ ও শান্তি থাকবে, এবং জাহান্নাম (নরক), যেখানে শাস্তি ও কষ্ট। আখিরাতের এই বাস্তবতা মানুষের আচরণ ও জীবনযাত্রার জন্য সতর্কবার্তা।
৫. আত্মার অস্তিত্ব ও ফিরিশতাদের ভূমিকা:
আখিরাতে মানুষের আত্মা ফের জীবিত হবে। ফিরিশতা (দূত) মানুষের কাজ লিপিবদ্ধ করে রাখে এবং আখিরাতের বিচার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে।
আখিরাতের প্রতি সুন্নি বিশ্বাসের বৈশিষ্ট্য
সুন্নি মতবাদের বিশেষত্ব হলো আখিরাতের বিশ্বাসের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য এবং কুরআন ও সাহিহ হাদিসের উপর নির্ভরশীলতা।
আখিরাতকে স্বীকার করা ঈমানের শর্ত:
আখিরাতের প্রতি ঈমান আনতে হবে অন্ধ বিশ্বাসে নয়, বরং আল্লাহর রসুল (সা:) এর সুস্পষ্ট বর্ণনা অনুযায়ী। যেমন: মৃত্যুর পর আত্মার অবস্থা, কিয়ামত, হিসাব, সওয়াব ও দণ্ডের ব্যাপারে সুন্নাহ থেকে জানা যায়।
অবস্থার বিবরণে বিশদ ধারণা:
সুন্নি ধর্মীয় গ্রন্থে আখিরাতের বিভিন্ন স্তর যেমন কবরের জীবন, মিরাজ, শাফা’আত, জাজম ও সিজদা, হিজর-উল-মহম্মাদ (সাহাবাদের জিজ্ঞাসিত প্রশ্নোত্তর) ইত্যাদি স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।
কিয়ামত ও আখিরাতের বাস্তবতা নিয়ে সংশয় বা অবিশ্বাস কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান:
সুন্নি ঐক্য গড়ে তোলার জন্য আখিরাতের বিশ্বাসের অবমাননা বা নাকচকে অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ পাপ হিসেবে ধরা হয়।
আখিরাতের বিশ্বাস মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব
সুন্নি দৃষ্টিভঙ্গিতে আখিরাতের বিশ্বাস মানুষকে নৈতিক ও ধার্মিক জীবনে পরিচালিত করে। এটি বিভিন্ন দিক থেকে মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে—
সৎ কাজ ও ত্যাগে অনুপ্রেরণা:
আখিরাতের পুরস্কার ও শাস্তির কথা জানলে মানুষ ন্যায়পরায়ণ ও সৎ পথে চলতে উদ্বুদ্ধ হয়। এটি বেহেশত লাভের আকাঙ্ক্ষায় কাজ করার উৎস।
ধৈর্য ও সংযমের শিক্ষা:
এই দুনিয়ার কষ্ট ও কল্পবিরোধী অবস্থার মধ্যেও আখিরাতের সোনালী জীবনকে স্মরণ করে ধৈর্য ধারণ করা হয়।
নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ:
আখিরাতের হিসাববিধান মানুষের মধ্যে সততা, অন্যায় থেকে বিরত থাকার প্রবণতা সৃষ্টি করে। যেমন, যে ব্যক্তি জানে যে তার প্রতিটি কাজ হিসাব করা হবে, সে মিথ্যা, চুরি, অন্যায়ের পথ গ্রহণ করবে না।
সমাজে সৎ ও দায়িত্বশীল মানুষের সৃষ্টি:
যেহেতু প্রত্যেকেই আখিরাতে জবাবদিহি করবে, তাই ব্যক্তি সমাজের কল্যাণে কাজ করবে, অপরাধ কমবে ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশ পাবে।
আখিরাতের প্রতি অবিশ্বাস ও তার ক্ষতিকর প্রভাব
সুন্নি ইসলামে আখিরাতের প্রতি অবিশ্বাস বা অনাস্থা কঠোরভাবে নিন্দনীয়। যারা আখিরাতকে অস্বীকার করে বা উপেক্ষা করে, তাদের জন্য এটি ঈমানের একটি মারাত্মক শর্ত ভঙ্গ। এর ফলে ব্যক্তির জীবনধারা ধ্বংসাত্মক হয়—
পার্থিব স্বার্থ ও আনন্দে লিপ্ত হওয়া।
নৈতিক অবক্ষয় ও অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি।
অন্যায় ও অবিচারের দিকে ঝোঁক।
পরকালের শাস্তির ভয় না থাকায় তৎপরতা কমে।
সুন্নি উলামাদের বর্ণনায় আখিরাত
সুন্নি ঔলামারা আখিরাতকে মুসলিম জীবন ও বিশ্বাসের প্রাণ বলে বর্ণনা করেছেন। ইমাম বুখারী ও মুসলিমসহ অন্যান্য হাদিস গ্রন্থে পরকালের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আখিরাতের বিশ্বাসই মানুষকে আল্লাহর ভয় ও ভালো কাজের পথে পরিচালিত করে।
মাওলানা ইমাম আবু হামিদ আল-গাজ্জালী (রহঃ) তার বই “ইহ্যাউ উলূমুদ্দীন” এ উল্লেখ করেছেন—
“আখিরাতের বিশ্বাস হলো ঈমানের প্রাণ; যার মধ্যে বিশ্বাসী মনের শান্তি এবং দুনিয়ার চিন্তা থেকে মুক্তি।”
উপসংহার
আখিরাতের প্রতি সুন্নি দৃষ্টিভঙ্গি হল একটি সুস্পষ্ট ও পরিপূর্ণ বিশ্বাস যে, এই পৃথিবীর জীবন পরীক্ষা, আর মৃত্যুর পর আছে চিরস্থায়ী জীবনের স্থান—জান্নাত বা জাহান্নাম। এই বিশ্বাস মানুষকে সৎ ও ধার্মিক জীবনের পথে পরিচালিত করে, ন্যায় ও দায়িত্ববোধ গড়ে তোলে, সমাজে শান্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে।
আমরা সবাইকে অবশ্যই আখিরাতের প্রতি দৃঢ় ঈমান রাখার আহ্বান জানাই এবং সেই বিশ্বাস অনুযায়ী জীবন গঠন করে পরকালের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। কারণ, আখিরাতের সঠিক ধারণা ছাড়া কোনো মুসলিম জীবন পরিপূর্ণ হতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে প্রকৃত ঈমান এবং নেক আমল করার তৌফিক দান করুন, আমীন।