সালাত আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় ইবাদত। প্রতিদিন আমরা ১৭ রাক‘আত ফরজ সালাত, ১২ রাক‘আত সুন্নতে মুয়াক্কাদা এবং ৩ রাক‘আত বীতরসহ মোট ৩২ রাক‘আত নামাজ আদায় করি। এর বাইরে নফল নামাজও নিয়মিত পড়ে থাকি। কিন্তু অনেক সময় প্রত্যেক রাকআতে ছোট ছোট ভুল হলে এগুলো জমা জমা হয়ে সালাতের সাওয়াব কমতে পারে, এমনকি গোনাহ হওয়ার আশংকাও থাকে। সালাতের শুদ্ধতা আমাদের ঈমানের অন্যতম চাবিকাঠি, তাই এর ছোট থেকে বড় সব ভুলত্রুটি এড়ানো জরুরি।
আজকের খুতবায় আমরা সালাতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিধান ও নিয়ম নিয়ে আলোচনা করব, যেগুলো নিয়মিত মুসল্লিরা ভুল করে থাকেন এবং সুন্নি শিক্ষার আলোকে শুদ্ধ সালাতের মূল দিকগুলো তুলে ধরব।
১. সালাতের মূল উদ্দেশ্য: মনোযোগ ও আল্লাহর যিকর
সালাতের মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর যিকর ও স্মরণ করা। আল্লাহ কুরআনে বলেন:
وَأَقِمِ الصَّلاةَ لِذِكْرِي
“আমার যিকর বা স্মরণের জন্য সালাত প্রতিষ্ঠা কর।” (সূরা তাহা: ১৪)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিখিয়েছেন, সালাতের প্রতিটি বক্তব্য অর্থ বুঝে আবেগ ও মনোযোগ দিয়ে উচ্চারণ করতে হবে। তবে বাস্তবে আমরা অনেক সময় নেশাগ্রস্ত বা অসচেতন অবস্থায় নামাজ আদায় করি, যা আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথে বড় বাঁধা। আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لا تَقْرَبُوا الصَّلاةَ وَأَنْتُمْ سُكَارَى حَتَّى تَعْلَمُوا مَا تَقُولُونَ
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা যা বল তা বুঝতে পারছ, এমন অবস্থা না হওয়া পর্যন্ত নামাজের নিকটবর্তী হয়ো না।” (সূরা নিসা: ৪৩)
সুতরাং, সালাতের মধ্যে সচেতন থাকা, অর্থ অনুধাবন ও মনোযোগ রাখা অত্যন্ত জরুরি।
২. সতর আবৃত থাকা: পুরুষ ও মহিলাদের জন্য ফরজ
সালাতের শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো শরীরের নির্দিষ্ট অংশ সতর আবৃত রাখা। পুরুষের জন্য নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত আবৃত রাখা ফরজ। এর কিছু অংশ অনাবৃত হলে সালাত নষ্ট হয়। অনেক সময় টাইট বা ছোট পোশাকের কারণে সতর রক্ষা হয় না, যা সালাতের গ্রহণযোগ্যতা কমিয়ে দেয়।
মহিলাদের জন্য সালাতের সময় পুরো শরীর (মুখম-ল ও কব্জি বাদে) আবৃত রাখা ফরজ। বিশেষ করে চুল, গলা, কান ও পায়ের নলা আবৃত রাখতে হবে। সাধারণ পাঞ্জাবি বা শাড়ীর পরিবর্তে ঢিলেঢালা সেলোয়ার-কামিজ বা ম্যাক্সি ধরনের পোশাক বেশি উপযোগী।
৩. সুতরা রাখা এবং সুতরার নিকটে দাঁড়ানো
সালাতের সময় সামনে আড়াল বা সুতরা রাখা সুন্নত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন:
لا تُصلّ إلا إلى سترة ولا تدع أحدا يمر بين يديك…
“সুতরা ছাড়া নামাজ পড়া যাবে না এবং কাউকে তোমার সামনে দিয়ে যেতে দিও না।” (বুখারী)
যদিও জামাতে ইমামের সুতরাই যথেষ্ট, কিন্তু একা নামাজ পড়ার সময় সুতরা বা আড়াল রাখা উত্তম। এটি শয়তানের হাত থেকে সুরক্ষা দেয়।
৪. ধীর ও শান্ত তিলাওয়াত ও আদায়
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুব ধীরে ধীরে সূরা ফাতিহা ও অন্যান্য আয়াত পড়তেন। প্রতিটি আয়াতের পর থামতেন যাতে অর্থ উপলব্ধি করা যায়। (হাদীস: উম্মুল মুমিনীন উম্মু সালামাহ রা.)
তাড়াহুড়ো করে তিলাওয়াত ও রুকু, সিজদা করা ভুল। শান্তিপূর্ণ ও ধীর গতিতে আদায় করলে সালাত পরিপূর্ণ হয় এবং মনোযোগ বজায় থাকে।
৫. রুকু ও সিজদায় সঠিক ভঙ্গি
রুকুতে পিঠ লম্বা ও সোজা রাখা ফরজ। হাত হাঁটুর উপরে রেখে রুকুতে যেতে হবে। সাজদায় সাতটি অংশ মাটিতে স্পর্শ করতে হবে: কপাল ও নাক (মুখম-ল), দুই হাত, দুই হাঁটু ও দুই পা। কনুই মাটিতে লাগানো যাবেনা।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ভঙ্গি অনুসরণ করলে সালাতের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়।
৬. জামাতে সালাতের নিয়ম ও আদব
মসজিদে আগেই গিয়ে ওজু করে শান্তভাবে অপেক্ষা করা উচিত।
তাড়াহুড়ো করে না গিয়ে গাম্ভীর্য নিয়ে সালাতের জন্য আসা উত্তম।
প্রথম কাতারে দাঁড়ানো অতীব সওয়াবের কাজ। প্রথম কাতার আল্লাহ ও ফেরেশতারা দোয়া করেন।
কাতার সোজা রাখা, গায়ে গা লাগানো, কাঁধে কাঁধ মিলানো অত্যন্ত জরুরি। শয়তান কাতার বিভক্ত করলে তা নষ্ট হতে পারে।
জামাতে ইমামের নির্দেশ মেনে চলা এবং অন্যান্যদের অসুবিধা না করা ইবাদতের অংশ।
৭. মনোযোগ হারালে মনোযোগ ফিরিয়ে আনা
সালাতের মধ্যে যদি মনোযোগ কমে যায়, তা হলে যেন দ্রুত মনোযোগ ফিরে আনা হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শয়তানের বাধা ঠেকাতে তিনবার “আঊযু বিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম” পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
৮. সালাতের গুণগত মানের দিকে মনোযোগ দেওয়া
শুধুমাত্র রাকআত গোনা বা দ্রুত নামাজ শেষ করা যথেষ্ট নয়। শুদ্ধ নিয়ত, মনোযোগ, শান্তিপূর্ণ আদায়, শরীরের সতর ও সুন্নাহ মেনে চলাই সালাতের সঠিক মান নিশ্চিত করে।
উপসংহার
সালাত হলো ঈমানের প্রাণ ও জীবনের মেরুদণ্ড। সুন্নি দৃষ্টিতে সালাতের শুদ্ধতা নিশ্চিত করতে হলে তার ছোট থেকে বড় সব শর্ত, সুন্নাহ মেনে চলা, মনোযোগ ও ধৈর্য বজায় রাখা আবশ্যক। ছোটখাটো ভুলের জন্য অনেক সময় ক্ষমা আছে, তবে গুরুতর ভুল এড়িয়ে চলতে হবে।
আমরা যেন প্রতিদিন সালাত আদায়ের সময় আল্লাহর যিকর ও স্মরণের জন্য গভীর মনোযোগ ও আবেগ নিয়ে নামাজ আদায় করি, যেন আমাদের সালাত আল্লাহর নৈকট্যের দরজা খুলে দেয়।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সুন্নাত মোতাবেক শুদ্ধ সালাত আদায়ের তাওফীক দিন। আমীন।